
হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার পর ইরান তা পুনরায় খুলে দেবে কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বিষয়ে ইরানের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা এটাই প্রমাণ করেছি আমরা কখনো আগ্রাসী শক্তি ছিলাম না, আমরা আগ্রাসনের শিকার হয়েছি। আমরা আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিয়েছি। ভবিষ্যতে যদি ফের কোনো আগ্রাসন হয় তা হলে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সে আগ্রাসন মোকাবেলা করব। বিশেষ করে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত যেভাবে আগ্রাসী শক্তির মোকাবেলা করেছে এ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।
নয়া দিগন্ত : ইরানের সাথে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে ইসরাইল ও আমেরিকা ইরানে হামলা করে। বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে ইরান।
মানসুর চাভোশী : ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা এবং ড. পেজেশকিয়ান-এর নেতৃত্বাধীন সরকার উত্তেজনা নিরসন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। ফলে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনার পথ বেছে নিয়েছিল এবং একটি কাঠামোর আওতায়, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার বজায় রাখার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের বৈধ অধিকার ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে একমত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ ষষ্ঠ পর্বের পরোক্ষ আলোচনা শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ইরান ইসরাইলি আগ্রাসন এবং এর পর পরই যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মুখে পড়ে।
নয়া দিগন্ত : এর আগেও দেখা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে ইরান জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের প্রথম শাসনামল শুরু হওয়ার পর তিনি এ চুক্তি থেকে একতরফা বের হয়ে যান।
মানসুর চাভোশী : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এমনকি জায়োনিস্ট শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মাঝেও কূটনৈতিক পথ অনুসরণে অটল ছিল। গত কয়েক দিনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এবং এর পর ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) বৈঠকে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে আলোচনায় লিপ্ত ছিলেন। ঠিক সেই সময়ই ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের শিকার হয় এবং ফোরদু, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে অবস্থিত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সরাসরি সামরিক হামলা চালানো হয়।
নয়া দিগন্ত : ইরানে হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কোন পর্যায়ে রয়েছে?
মানসুর চাভোশী : আগ্রাসী হামলায় অনেক নারী ও শিশু মারা গেছে। নিহতরা নিরীহ ও নির্দোষ ব্যক্তি ছিল। নিহত ও আহতের সংখ্যা পরিবর্তন হচ্ছে। ধ্বংসের পরিমাণ এবং সম্ভাব্য তেজস্ক্রিয় দূষণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা তদন্ত করছে এবং এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রদান করবে।
নয়া দিগন্ত : জাতিসঙ্ঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক রীতি উপেক্ষা করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ইরানের ওপর ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছে, বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে ইরান?
মানসুর চাভোশী : বিশ্বে এই প্রথমবার, দু’টি পরমাণু ক্ষমতাধর দেশ- যার মধ্যে একটি অতীতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং অন্যটি এনপিটি (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি)-এর সদস্যও নয় এবং সবসময় তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি গোপন রেখেছে- একটি নিরস্ত্র, এনপিটি সদস্য এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনাকারী দেশের ওপর সামরিক হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থাগুলোর ব্যর্থতা এবং আত্মরক্ষায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ন্যায্য অবস্থানের প্রমাণ।
নয়া দিগন্ত : ইরানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে ইসরাইল। যদিও ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ফতোয়া জারি রয়েছে। ইরানের পার্লামেন্টে আইন করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং ইরানে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরান কি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে?
মানসুর চাভোশী : ইরান কখনো পারমাণবিক অস্ত্র বানাবার চেষ্টা করছে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। একই সঙ্গে, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের বৈধ অধিকার থেকেও ইরান কখনো সরে দাঁড়ায়নি এবং দাঁড়াবে না।
নয়া দিগন্ত : ইসরাইল বারবার অভিযোগ করছে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।
মানসুর চাভোশী : ইরানে কখনো কোনো সক্রিয় পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠীর এই আগ্রাসন আন্তর্জাতিক ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা রাখে না।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু তার পরও তো ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মানসুর চাভোশী : এই আগ্রাসী পদক্ষেপগুলো ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের শাসনব্যবস্থার প্রতি জনগণের সংহতি আরো দৃঢ় করেছে এবং জনগণ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক দায়িত্বশীলদের সঙ্গে ঐক্য ও সহমর্মিতার মাধ্যমে আমাদের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং জায়োনিস্ট শাসকগোষ্ঠীর এই আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক বিধানসমূহ এবং জাতিসঙ্ঘ সনদের (ধারা ২) স্পষ্ট লঙ্ঘন- বিশেষত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা নিষিদ্ধ করার নিয়মের পরিপন্থী এবং এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি একটি গুরুতর হুমকি। এ ধরনের পদক্ষেপ সব দিক থেকে নিন্দাযোগ্য। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে বক্তব্য রেখেছেন এবং এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
নয়া দিগন্ত : ইরান এই আগ্রাসন মোকাবেলায় অন্যান্য দেশের কাছ থেকে কী ধরনের সমর্থন আশা করে?
মানসুর চাভোশী : সকল দেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্যদের প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে তারা এই স্পষ্ট এবং অবৈধ আগ্রাসনকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিন্দা জানাবে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র ও জায়োনিস্ট শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে জোর দিয়ে বলেছে যে, আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষা এবং অবৈধ কার্যক্রমের মূল্য চোকাতে আইনগত ও আন্তর্জাতিক দায়িত্বের প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নয়া দিগন্ত : ইরানে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলা হচ্ছে।
মানসুর চাভোশী : ইন্টারনেট ফ্যাসিলিটি চালু আছে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেট সংযোগ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল।
নয়া দিগন্ত : মার্কিন অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ভয় পায়। কারণ ইরান আর পাঁচটি দেশের মতো নয় বরং ইরানের একটি মিশন রয়েছে, বিশ্বাসের দৃঢ় শিকড় রয়েছে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
মানসুর চাভোশী : মরগান ফ্রিম্যান হয়তো তার ধারণার দিক থেকে ইরান সম্পর্কে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইরান শত শত বছর ধরে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ে আসছে এবং আমরা লড়ে যাব। এ লড়াই অব্যাহত রাখার জন্য ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি মঙ্গলবার ভোরে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে, ইরানিদের পক্ষ থেকে দেশের ‘শক্তিশালী’ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ইরানিরা প্রিয় দেশকে তাদের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত রক্ষা করতে প্রস্তুত এবং তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুর যেকোনো আক্রমণের জবাব দিয়েছে।