
বিদেশগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেডিক্যাল সেন্টারগুলো সিন্ডিকেটের কবলে। অতিমুনাফা লোভী কতিপয় মেডিক্যাল সেন্টারের মালিকের সিন্ডিকেটের দরুণ গালফ কো-অপারেটিভ কাউন্সিল (জিসিসি) অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলো বিপাকে পড়েছে। সিন্ডিকেট চক্র প্রায় চল্লিশটি মেডিক্যাল সেন্টারের মাধ্যমে একচেটিয়া ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওয়াফিদ বা চয়েস সিøপ পদ্ধতির পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট চক্র। সিন্ডিকেটের বাইরে থাকা সমবন্টনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলো বিদেশগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ না পেয়ে ব্যবসায়ীকভাবে ভেঙ্গে পড়ছে।
অধিকাংশ মেডিক্যাল সেন্টার প্রতিদিন মাত্র ৫/৭টি স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কাঙ্খিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কর্মী না পেয়ে অনেকের অফিস বন্ধ হবার উপক্রম। সমবন্টন থেকে বঞ্চিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলো কর্মচারীদের বেতন এবং বাড়ী ভাড়া পরিশোধ করতে পারছে না। এনিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা দেয়ার পরেও সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে কোনো সাড়া মিলছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুটিকয় মেডিক্যাল সেন্টার মালিকের নির্লজ্জ সিন্ডিকেটের দরুণ গালফ কো-অপারেটিভ কাউন্সিল (জিসিসি) অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলো অফিস চালাতে হিমসিম খাচ্ছে। জিসিসির আওতাভুক্ত দেশের দুই শতাধিক বেশি মেডিক্যাল সেন্টারের মধ্যে মাত্র ওই ৪০টি সেন্টার ৯৫ শতাংশ মেডিক্যাল চেকআপ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ৪০ সেন্টারের মালিকও ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি। তাদের বিরুদ্ধে মেডিক্যাল চেকআপে জিজিসি নির্ধারিত সাড়ে ৮ হাজার টাকার পরিবর্তে কোনো কোনো শ্রমিকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারা সার্ভার ম্যানুপুলেট ও হ্যাংয়ের মাধ্যমে অন্য মেডিক্যাল সেন্টারকে যেমন বঞ্চিত করছে, তেমনি নিজেরা কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করে সেটা বিদেশে পাচার করছে। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাবেক গামকা বর্তমানে জিসিসি অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টার মালিকরা এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানান। তারা সিন্ডিকেটের হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও তাদের লাইসেন্স বাতিল করার দাবিও জানান। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যগামী শ্রমিকদের মেডিক্যাল চেকআপে অনিয়ম দূর করে সমবণ্টনের দাবি জানিয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতে হলে শ্রমিকদের জিসিসি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল সেন্টার থেকে মেডিক্যাল চেকআপ করাতে হয়। এন্ট্রি সিøপ জন্য দিতে হয় বেশকিছু টাকা। রক্তের এইচআইভি, মূত্র পরীক্ষাসহ কয়েকটি পরীক্ষা ও বুকের একটি এক্স-রের জন্য জনপ্রতি মেডিক্যাল সেন্টারে জমা দিতে হয় সাড়ে ৮ হাজার টাকা। অনেক সময় দালালের মাধ্যমে যারা বিদেশ যায়, তাদের কেউ যদি আনফিটও হয়, তবুও টাকার বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে গামকার সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠান কারসাজির মাধ্যমে কমবেশি মেডিক্যাল চেকআপ করছে। আমরা মেডিক্যাল সেন্টারের মালিকরা নিজেদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা সব মালিকের জন্য ইক্যুয়াল বা সমবণ্টন চাই। শিগগির এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেব। তার কোনো মেডিক্যাল সেন্টার সিøপ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে তিনি দাবি করেন।
একাধিক মেডিক্যাল সেন্টারের অভিযোগ, কক্সবাজার, বরিশাল ও রাজশাহীর মেডিকেল সেন্টারগুলোর নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ বেশি। এরই মধ্যে কক্সবাজার, বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে জাল মেডিক্যাল রিপোর্ট দেওয়ার একাধিক সেন্টার। যেসব সেন্টারের মাধ্যমে জাল প্রতিবেদন ও ভুয়া প্রতিবেদন ইস্যুর অভিযোগ উঠেছে সেগুলো হচ্ছে কক্সবাজারের আল-ম্যান মেডিক্যাল সেন্টার, বে-মেডিক্যাল সেন্টার, কমন হেলথ কেয়ার, ম্যাক্স মেডিকেল সেন্টার ও সুকো মেডিকেল পয়েন্ট। রাজশাহীর আল-আলী ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল-নাহিয়ান ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল সার্ভিস, হোপ মেডিক্যাল সেন্টার, নাজওয়া মেডিক্যাল সেন্টার ও সততা মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টার।
সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে জড়িত রাজধানী ঢাকার মেডিক্যাল সেন্টারগুলোর মালিকদের মধ্যে অনেক হোমড়া- চোমড়াও রয়েছে। এরা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এসব সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জন্য আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে মেডিক্যাল সেন্টারগুলোর উদ্যোগে জরুরি সভা আহবান করা হয়েছে। এসব মেডিক্যাল সেন্টারের বিরুদ্ধে আনফিট শ্রমিকদের ‘ফিট’ রিপোর্ট দেওয়া এবং অনলাইনে আপলোড দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
চয়েস সিøপ ওঠানোর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত হোমড়া-চোমড়ারা জিসিসি অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারে চয়েস সিøপ ও হ্যাকিং কারবারে যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ এসেছে তারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। জানা গেছে, বশিরের একাদিক মেডিক্যাল সেন্টার এবং রাজশাহীর হোপ ও কক্সবাজারের বে মেডিক্যাল সেন্টারের মালিকানাও তার। জসিম উদ্দিন সৈয়দের, খোরশেদ আলমের, গামকার সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাসের, নোমান চৌধুরী ও তার ভাই এনাম চৌধুরীর রয়েছে একাধিক মেডিক্যাল সেন্টার। সিন্ডিকেট চক্র বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মেডিক্যাল সেন্টার মালিকদের ঠকিয়ে পুরো মেডিক্যাল চেকআপ কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিক্যাল সেন্টার মালিক জানান, সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয় করে মেডিক্যাল সেন্টার করেছি। দিনে কাজ পাই চার থেকে পাঁচটি। লাভ দূরে থাক, কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারছি না। অথচ সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা দেদারসে একটি সেন্টারেই দিনে আড়াইশ থেকে চারশ’ পর্যন্ত মেডিক্যাল চেকআপ করে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। একাধিক মেডিক্যাল সেন্টারের মালিক অভিযোগ করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যগামী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে ভয়াবহ প্রতারণা চলছে। জিসিসি অনুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলোর সমন্বয়কারী সংস্থা জিএইচসির ওয়াফিদ পদ্ধতির (চয়েস সিøপ) আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী মাফিয়া চক্র, যারা বছরে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করছে।
ভুক্তভোগীরা আরও বলেন, সউদী আরব, ওমান, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও ইয়েমেনগামী কর্মীরা বর্তমানে জিসিসি ওয়াফিদ মাফিয়া চক্রের কবলে পড়েছে। অনলাইন ওয়াফিদ সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট মেডিক্যাল সেন্টার বেছে নেওয়া যায়। এজন্য তাদের বাড়তি কিছু ডলার ব্যয় করতে হয়। অভিযোগ উঠেছে, অসাধু সেন্টারগুলোতে পরীক্ষার নামে টাকা নিয়ে ফিট রিপোর্ট দেওয়া হয় এমন শ্রমিকদের যারা আসলে আনফিট। প্রতিটি ভুয়া রিপোর্ট ইস্যুর জন্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। অথচ সরকার নির্ধারিত ফি মাত্র ৮ হাজার ৫০০ টাকা। ওয়াফিদ পদ্ধতিকে ফাঁকি দিয়ে কোনো কোনো সেন্টার দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ শ্রমিকের মেডিক্যাল রিপোর্ট তৈরি করে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরের সেন্টারগুলোর নামে ওয়াফিদ সিøপ তুলে ঢাকায় মেডিক্যাল চেকআপ করিয়ে ফের রিপোর্ট আপলোড দেওয়া হচ্ছে ওইসব সেন্টারের নামে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুখ বায়রার সাবেক নেতা ইনকিলাবকে বলেন, জালিয়াত চক্রের কারণে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অভিবাসন বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জাল প্রতিবেদনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করা অনেক শ্রমিক বিদেশে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আনফিট হিসেবে ধরা পড়েছেন। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে বর্হিবিশ্বে দেশে আমাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। এসব সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধের জন্য বায়রার ওই সাবেক নেতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।