Image description

চট্টগ্রামের নির্মাণখাতে মহামন্দা চলছে। সরকারি-বেসরকারি ছোট বড় উন্নয়ন প্রকল্প প্রায় বন্ধ। ব্যক্তিগত খাতের নির্মাণকাজেও চলছে স্থবিরতা। আবাসন শিল্পে চরম দুর্দিন যাচ্ছে। সামগ্রীক উন্নয়ন কর্মকা-ে অচলাবস্থার কারণে নির্মাণ সামগ্রির চাহিদা পড়ে গেছে। ফলে রড, সিমেন্ট, ইট, পাইপ ফিটিংসসহ বিভিন্ন খাতের কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাতে বেকারত্ব এবং সেই সাথে হতাশা বাড়ছে।

উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিল্প-কারখানা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় আছেন। তারা এই সময়ে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। বিদেশি বিনিয়োগের খরাও কাটছে না। ফ্যাসিবাদিদের লুটপাটে ক্ষত বিক্ষত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গতি ফিরছে না। টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক হচ্ছে না।

ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন এক অভ্যুত্থানে বিগত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতন হয়। সাড়ে ১৫ বছর জাতির কাঁধে চেপে বসা ফ্যাসিবাদি শাসনের অবসানে দেশে উন্নয়ন-বিনিয়োগের নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগে রির্জাভ খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর্থিকখাতেও শৃঙ্খলা ফিরছে। হাসিনা ও তার দোসরদের লুটপাট আর অর্থপাচারে ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এগারো মাসেও গণতন্ত্রে ফেরার কোন পথ-নকশা রচিত না হওয়ায় অনিশ্চয়তা কাটছে না। স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়নি। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে।

বিগত সরকারের সময়ে চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। মেগা প্রকল্পের নামে মেগা লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব প্রকল্পের লাগাম টেনে ধরে। অতিপ্রয়োজনীয় প্রকল্প পর্যালোচনা করে ব্যয় সংকোচন নীতিতে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প স্থগিত করা হয়। আবার ফ্যাসিবাদের দোসর অনেক ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়ে যায়। আটকে যায় প্রকল্পের বাকি কাজ। অন্যদিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ের উন্নয়ন. বিনিয়োগেও স্থবির হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তিতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ দেশে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয় তাতে উন্নয়ন-বিনিয়োগ রীতিমত মুখ থুবড়ে পড়ে। তাতে বড় ধরনের ধাক্কা খায় নির্মাণখাত।

নগরীর আগ্রাবাদের রড, সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রী ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, বিগত প্রায় দশ মাসের বেশি সময় ধরে নির্মাণ সামগ্রির ব্যবসায় মন্দাবস্থা চলছে। আগের তুলনায় বেচাকেনা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন ক্রেতা মিলছে না। আগে যারা বাড়ি বা ভবনের কাজ শেষ করে এনেছেন তারা কিছুটা কেনাকাটা করছেন। অনেকে কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। নতুন করে আবাসন বা নির্মাণখাতে কোন কাজ হচ্ছে না। আবাসন খাতের সাথে প্রায় আড়াই শতাধিক ছোট বড় শিল্প জড়িত। সর্বত্র এখন হাহাকার অবস্থা। এই খাতের হাজার হাজার শ্রমিক এখন বেকার।

নির্মাণ সামগ্রী বিশেষ করে রড, সিমেন্টের চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ইস্পাত ও সিমেন্ট কারখানা তাদের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের অন্যতম পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম বলেন, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমে যাওয়ায় বাজারে নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা তেমন নেই। আর এই কারণে ইস্পাত, সিমেন্টসহ সংশ্লিষ্ট খাতের অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে শিল্প উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারীরা লোকসান গুনছেন। ব্যাংক ঋণের বোঝা বাড়ছে। কারখানা বন্ধ থাকায় কর্মহীন তথা বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।

দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তার কারণে সার্বিক বিনিয়োগ খাতে মন্দা চলছে। তিনি মনে করেন দেশে নির্বাচিত সরকার আসলে খুব শিগগির এ অচলাবস্থা কেটে যাবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আস্থা ফিরে পাবেন। তখন বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। বিএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, রডসহ নির্মাণ সামগ্রীর চাহিদা কমে গেছে। আমাদের কারখানা চালু থাকলেও উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করা হচ্ছে। বিনিয়োগ নেই, তাই চাহিদা নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন বিনিয়োগ করছে না। নির্বাচিত সরকার আসলে বিনিয়োগ বাড়বে, তখন উৎপাদনও স্বাভাবিক হবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।

রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অনিশ্চিয়তার কারণে বিনিয়োগে সক্রিয় হচ্ছে না অনেকে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আবাসন খাতে। চট্টগ্রামে রিহ্যাবের সদস্য সংখ্যা ৮০। এর বাইরে আরো দুইশতাধিক ছোট বড় আবাসন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় এখন মন্দা চলছে। অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। নতুন প্রকল্পও নেওয়া হচ্ছে না। ফ্ল্যাট ক্রয় প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এই শিল্পে জড়িত। সরকারের পতন হওয়ায় তাদের অনেকে দেশে-বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অনেকে কারাবন্দি আছেন। তাদের ব্যবসাও এখন প্রায় বন্ধ।

চট্টগ্রামের অন্যতম আবাসন প্রতিষ্ঠান স্যানমার প্রপার্টিজের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম বিন সালেহ বলেন, আবাসন ব্যবসা কিছুটা খারাপ যাচ্ছে। দেশে নির্বাচিত সরকার আসলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
রিহ্যাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের চেয়ারম্যান হাজি দেলোয়ার হোসেন বলেন, আস্থার সঙ্কটের কারণে আবাসন খাতে মন্দা নেমে এসেছে। মানুষের হাতে টাকা আছে, বিনিয়োগের আগ্রহও আছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিশেষ করে নির্বাচিত সরকার না থাকায় অনেকে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। বিনিয়োগকারীরা এখনও নিশ্চিত হতে পারছেন না, এই সরকার কতদিন থাকবেন, অথবা নির্বাচিত সরকার কখন আসবে। তবে নির্বাচিত সরকার আসলেই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া শুরু হবে।

আবাসন ব্যবসায়ী আব্দুল গাফ্ফার মিয়াজি বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নির্মাণখাত বিশেষ করে আবাসন খাতে স্থবিতরা চলছে। এই খাত সচল হওয়ার অর্থ হলো দেশের সার্বিক অর্থনীতি সচল হওয়া। কারণ আবাসনের সাথে আড়াশ রকমের শিল্প জড়িত। জিডিপিতেও এই খাতের অবদান রয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমানের মধ্যে ঐতিহাসিক লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এরফলে দেশের রাজনীতি এবং গণতন্ত্রে ফেরার পথে সব অস্পষ্টতা কেটে গেছে। এখন সেই ঘোষণা ধরে নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের পথ-নশকা দিলেই আস্থাহীনতা কেটে যাবে। উন্নয়ন বিনিয়োগে অচলাবস্থার অবসান হবে এবং অর্থনীতিতে দ্রুত গতি সঞ্চার হবে।