
কানাডার রকি পর্বতমালার কোলে এবারের জি-৭ সম্মেলনে একত্রিত হয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ সাত অর্থনীতির নেতারা। ২০১৮ সালে এই সম্মেলনের সময় যে ধরনের উত্তেজনা ও বিরোধ দেখা গিয়েছিল, এবার তার পুনরাবৃত্তি এড়াতে মরিয়া আয়োজক দেশ ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো।
সেই ২০১৮ সালের কুইবেক সম্মেলনের স্মরণীয় একটি ছবি—যেখানে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সামনে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প—আজও বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় জায়গা করে নেয়। সেই সম্মেলনে একটি যৌথ বিবৃতি নিয়ে তৈরি হয় বড় ধরনের বিরোধ, যা শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প বাতিল করে দেন।
সাত বছর পর, মের্কেল অবসর নিয়েছেন, আবে ২০২২ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন, আর সেই সময়ের আয়োজক কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও জনপ্রিয়তা হারিয়ে চলতি বছর পদত্যাগ করেছেন। এবারের সম্মেলনে অংশ নেওয়া সাত রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে চারজনই প্রথমবারের মতো জি-৭ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন, যা বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে কানাডার কানানাসকিস শহরে শুরু হওয়া জি-৭ সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য সমস্যা। তবে এই সংকটগুলো কতটা গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ জানিয়েছেন, “আমাদের লক্ষ্য থাকবে ইরান যেন পরমাণু অস্ত্র না পায়, উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে এবং কূটনৈতিক সমাধানের পথ যেন খোলা থাকে।”
তবে এবার আয়োজক দেশ কানাডা এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৮ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে এবার আর কোনও যৌথ ঘোষণার পরিকল্পনা নেই। তার বদলে থাকছে স্বল্প আকারের, কার্যকরী বিবৃতি যা বিতর্ক সৃষ্টি না করে মূল সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এবার কিছুটা ভিন্নধর্মী আলোচনা হতে পারে। আগের সম্মেলনগুলোয় এ ইস্যুতে একমত থাকলেও এবার রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্ভাব্য বৈঠককে ঘিরে।
বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের কৌশল বরাবরের মতোই বিতর্কিত। তার প্রশাসন ইউক্রেন ইস্যুর চেয়ে বাণিজ্য আলোচনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাজ্য ছাড়া এখনো বড় কোনো বাণিজ্য চুক্তি হয়নি। সম্মেলনে নতুন কোনো চুক্তি ঘোষণার সম্ভাবনাও কম বলে জানানো হয়েছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি এবারের সম্মেলনকে আরও ‘মসৃণ’ রাখতে অতিরিক্ত বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে চলছেন। ট্রাম্পের মতবিরোধ এড়াতে সম্মেলনের সময়সূচি সাজানো হয়েছে তুলনামূলকভাবে ছোট ছোট বৈঠকের মাধ্যমে, যার মধ্যে রয়েছে ট্রাম্পের পছন্দের একান্ত বৈঠকের সুযোগও।
মেক্সিকোর নতুন প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেইনবামসহ অন্যান্য আমন্ত্রিত নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির কড়া সমালোচক শেইনবামের সঙ্গে তার আলাপ কতটা কূটনৈতিক হয়, সেটিও নজরে থাকবে বিশ্লেষকদের।
এবারের সম্মেলন আসলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হতে যাচ্ছে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম আন্তর্জাতিক পরিসরে। বহুপক্ষীয় বৈঠকে তার অনীহা আগেও দেখা গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি কেন সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
প্রাক্তন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ক্যাটলিন ওয়েলশ বলেন, “একদিকে ট্রাম্প বহুপাক্ষিক কাঠামো নিয়ে সন্দিহান। আবার অন্যদিকে, তিনি ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে থাকতে এবং নিজেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করেন।”
এই বৈপরীত্যই আসলে নির্ধারণ করবে এবারের জি-৭ সম্মেলনের ভবিষ্যৎ গতি।