
কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, অধিকার রক্ষা ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিতের অবস্থা থেকে সরে এসে বিচারিক ব্যবস্থাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ‘নিবর্তনকে বৈধ এবং বিরোধীদের অপরাধী’ বানানো হয়েছে।
ঊনিশ বছর বয়সী এক যুবক র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) হাতে ‘অপহরণের শিকার’ হয়ে গুম ছিলেন ২৮ দিন। ব্যাপক নির্যাতনের পর কর্মকর্তারাই তৈরি করে দেন একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি।
এরপর চাপ দিয়ে সেই জবানবন্দি তাকে মুখস্ত করানো হয়, বারবার মহড়ার পর নেওয়া হয় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। বিচারকের খাসকামরায় ভুক্তভোগী আবেদন জানান, পুলিশকে বের করে দিয়ে যেন নিয়মমাফিক জবানবন্দি নেওয়া হয়।
বিচারকের কাছে সেই আবেদন অগ্রাহ্য হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘জোর করে নেওয়া’ জবানবন্দিই রেকর্ড হয়।
গুমের শিকার হওয়া ওই ভুক্তভোগীর বর্ণনায় এভাবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায়ে বিচারকের ‘আইন না মানার’ কথা তুলে ধরেছে গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশন।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ছবি হাতে স্বজনরা
বিচার শুরুর আগে প্রথম শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো আসামি স্বীকারোক্তিমূলক যে জবানবন্দি দেন, তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করেন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট।
১৬৪ ধারায় একটি অংশে বলা হয়েছে, “কারও এ ধরনের স্বীকারোক্তি নেওয়ার আগে ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তির কাছে ব্যাখ্যা করবেন যে, তিনি এই স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নন এবং তিনি যদি স্বীকারোক্তি দিয়ে দেন এটা তার নিজের বিরুদ্ধেও ব্যবহার হতে পারে।
“এবং কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করার পর যদি প্রতীয়মান হয় যে, ওই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিচ্ছেন না, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তির স্বীকারোক্তি রেকর্ড করবেন না।”
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির এ বিষয়টি আসামির কাছে ব্যাখ্যা করা এবং স্বেচ্ছায় দেওয়া জবানবন্দি নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাক্ষর করার বিধানও আছে ওই ধারায়।
নির্যাতন এবং নানা উপায়ে বলপ্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি এক্ষেত্রে বিচারকরাও যে আইনের মানেননি, তা তুলে ধরা হয়েছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদনের একটি অংশে র্যাবের হাতে ‘গুম থাকা’ ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণের বরাতে লেখা হয়েছে, “আমি বললাম, ‘স্যার, আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। উনাদেরকে [অর্থাৎ পুলিশকে] আপনি
বের করেন রুম থেকে।’
“স্যার (ম্যাজিস্ট্রেট) বলছে, ‘উনারা বের হবে না, যা বলার এখানে বল।’ আমি বলছি, ‘স্যার, আমাকে উনারা গুম রাখছে। আমার বাবা-মা জানে না আজ পর্যন্ত আমি বেঁচে আছি কি মরে গেছি। ... এই যা লেখছে, আমাকে মুখস্ত করানো হইছে। স্যার, আমি এই সম্পর্কে কিছুই জানি না।’”
‘এক ধরনের জোর করে’ বিচারক সই নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ওই ভুক্তভোগী। কমিশনকে তিনি বলেন, “স্যার (ম্যাজিস্ট্রেট) কম্পিউটারে টাইপ দিয়ে অনেকগুলি লেখা কেটে দিছে। আরও লেখা বড় ছিল। ‘কই দেখো, অনেক লেখা কেটে দিছি, আর কাটা যাবে না। যা আছে এখানে সাইন করো।’
“আমি বললাম, ‘স্যার, আপনার সাথে আমার কথা আছে। স্যার, আমার সামনে পরীক্ষা। স্যার, আপনি উনাদেরকে বের করেন।’ কোনোভাবেই উনাকে আমি ম্যানেজ করতে পারলাম না।
“পরবর্তীতে যখন আমি এটা পড়তে গেলাম আবার, ম্যাজিস্ট্রেটের লেখাটা, তখন উনি আমাকে বলতেছে, ‘তোমার তো এত জায়গা-জমি নাই যে আমি লিখে নিয়ে যাব। সাইন করতে বলছি, সাইন করো।’... আমাকে উনি কোনো সুযোগ দেয় নাই। কোনো সময় দেওয়া হয় নাই।”

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহার করা এমন অনেক ঘরে আটকে রাখা হয় ধরে আনা ব্যক্তিদের। সরকার বদলের পর ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া এমন তিনটি বন্দিশালা ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের ক্ষেত্রে আইন না মেনে বিচারকদের জড়িত হয়ে যাওয়ার বর্ণনায় কমিশন লিখেছে, “বিভিন্ন সাক্ষ্যে উঠে এসেছে যে, স্বেচ্ছায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডের আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।
“যে কর্মকর্তা নির্যাতন করেছে, সেই কর্মকর্তা কর্তৃক ম্যাজেস্ট্রেটের সামনে উপস্থিতির কথা বলেছেন ভুক্তভোগীরা। এক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ ছিল না, কারণ ওই সময়টা ছিল হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর্যায়ে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটদের ‘অনাগ্রহী কিংবা তাড়াহুড়োর মধ্যে’ দেখা গেছে। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কেবল সিল-ছাপ্পড় মেরেছেন।
“কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোক্তীরা বলেছেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যেটা লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে তাদের দেওয়া বক্তব্যের কোনো মিল ছিল না। এটা কেবল চাপপ্রয়োগ নয়, বানোয়াট স্বীকারোক্তিরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।”
২০১৭ সালে র্যাবের হাতে ‘অপহরণের শিকার এবং ১১ দিন গুম থাকা ৩৭ বছর বয়সী একজনের বরাতে কমিশন লিখেছে, “১৬৪ করছিল, কিন্তু ১৬৪ মাইরা করছে ... আমার হাত বাঁধা, আমার দুইটা হাত বাঁধা। ... ম্যাজিস্ট্রেট আমারে জিজ্ঞেস করতেছে আর লিখতেছে।...
“একবার জিজ্ঞেস করছে, ‘আপনার বাসায় কি লাইব্রেরি আছিল?’ আমি বলছি, ‘আমার বাসায় বই ছিল, লাইব্রেরি ছিল।’ ‘তো আপনারা কি ওখানে বসে বন্ধুবান্ধব আড্ডা দিতেন?’ আমি বলছি, ‘মাঝে মাঝে আসত, গল্প করতাম...’ এই কথাটা আমি বলছি।”
এই বক্তব্য লিখিত জবানবন্দিতে পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, “কিন্তু সে এখানে যখন লেখছে, তার হাতের লেখা, সে লেখছে যে, আমি জিহাদি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম... আমি তো তাকে এই কথাটা বলি নাই কখনো... সে তো তার মত করে লিখল।...
“র্যাবের লোকরা যখন ১৬৪ রুমে ঢুকায়, তখন আমার চোখ বাঁধা। এটা যে ১৬৪ রুম, সেটাও তো আমি জানি না। র্যাবের থেকে আমারে বলছে, ‘যেভাবে শিখাইছি, সেভাবে বলবি। যদি না বলস, এখান থেকে বাইর আনার পরে তুই আর জীবন দেখবি না’।’”

গুম তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নির্যাতনের কায়দার এমন সব প্রতীকি ছবি ব্যবহার করেছে।
র্যাবের হাতে ৪২ দিন গুম থাকা ২৭ বছর বয়সী আরেক ভুক্তভোগী বলেছেন, “ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে গেছে... তো আমি উনার কাছে বললাম, এরা আমারে সদরঘাট থেকে এরকম এরকম কইরা নিয়ে আসছে। আমারে এদিকে আটকা রাইখা এতদিন আমারে মারছে, পিটাইছে। আমি জানি না, আমার বাসায় এরা কেমন আছে। ওরা জানে না আমি কেমন আছি...।
“তো উনি বলতেছে, ‘কি করমু ভাই? আপনার নাম তো এজহারের মধ্যে আছে।’ কয়, ‘এখন কি করমু? যেই মামলা, আপনারে রিমান্ড তো দেওয়াই লাগে।’ তো আমি বললাম, আমি এতটা দিন এগো কাছে ছিলাম। ‘কই ছিলেন?’ আমি বললাম, এই র্যাবরা দিয়া গেছে। র্যাবদের কাছে ছিলাম? ‘র্যাব অফিসে ছিলেন?’ বললাম, জি। ‘কি করমু এখন? এটা তো নিয়ম, দেওয়াই লাগে।’ তো উনি আবার তিন দিনের রিমান্ড দিছে।”
যেসব কায়দায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
ঘটনার ধারাবাহিকতা, আইনি বিকৃতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনার বিষয় পর্যালোচনা করে কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, অধিকার রক্ষা ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিতের অবস্থা থেকে সরে এসে বিচারিক ব্যবস্থাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ‘নিবর্তনকে বৈধ এবং বিরোধীদের অপরাধী’ বানানো হয়েছে।
এক্ষেত্রে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়, একই আইনে বারবার অভিযোগ গঠন, বারবার একই ধরনের অভিযোগ গঠন, আদালতের ক্ষতিসাধন এবং ভুক্তভোগীদের উপর সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়ার কথা তুলে ধরেছে কমিশন।
জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ে ‘বেআইনি পদ্ধতিগত (সিস্টেমেটিক) উপায়’ ব্যবহারের কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন বছর এবং বিভিন্ন এজেন্সির অনেকগুলো ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে গুমের শিকার এবং বিনাবিচারে আটকদের থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের একই রকম ‘ধারাবাহিক প্যাটার্ন’ উঠে এসেছে।
“এসব বর্ণনার মিল থেকে বলপ্রয়োগ, পদ্ধতির লঙ্ঘন এবং প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ-সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে নিজেকে অপরাধী হিসাবে স্বীকারোক্তি আদায়ের সমন্বিত একটি উপায় অবলম্বনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।”

গুম তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে নির্যাতনের কায়দার এমন সব প্রতীকি ছবি ব্যবহার করেছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের স্পষ্ট ভাষায় বলা ছিল, যদি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সই না করা হয় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পুনরায় জবানবন্দি না দেওয়া হয়, তাহলে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ ভোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে হেফাজতে থাক অবস্থায় সরাসরি হুমকি, শারীরিক নির্যাতন এবং মানসিক চাপ প্রয়োগের বর্ণনা দিয়েছেন বছরের পর বছর বিভিন্ন সংস্থার হাতে আটক ব্যক্তিরা।
“এর মধ্যে মেরে ফেলার হুমকি, নিরুদ্দেশ রাখার সময় দীর্ঘায়িত করা, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিসাধন এবং বারংবার নির্যাতন অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের হুমকি দেওয়া হত, আরোপিত বয়ান অনুসরণ না করলে মৃত্যু কিংবা আরও গুরুতর অভিযোগ অভিযুক্ত করা হবে।”
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে ২০২১ সালে ৩২ দিন ‘অপহরণের শিকার’ একজনের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, “আমাকে সারা রাস্তা বলে রাখছে, তুই যদি উল্টাপাল্টা করিস বা ১৬৪ না দিস, তাহলে তোর ওয়াইফকে নিয়ে আসব। তোকে ইচ্ছামত মারব।... আমাদের এখানে কোনো রুলস নাই, কেউ কিছু করতে পারবে না।"
২০১৭ সালে ডিজিএফআই এবং র্যাবের হাতে ২০৮ দিন গুমের শিকার আরেক ভুক্তভোগীর বরাতে বলা হয়, “চার মাস পরে নিয়ে গেল, আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে বলতেছে, ‘তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও, নাকি এভাবেই জীবন শেষ হয়ে যাবে?’ আমি বললাম, অবশ্যই আমি এখান থেকে বের হতে চাই।
“তখন বলে, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমরা যে কথাগুলো বলবো, তুমি কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাই বলবা।... তুমি যদি এটা বলো, তাহলে তুমি এখান থেকে বের হবা। আর যদি না বলো, তাহলে এখানে তোমাকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিব, তুমি মরবা’।”
২০২০ সালে সিটিটিসির হাতে তিনদিন ‘অপহরণের শিকার’ আরেক ব্যক্তির বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, “একটা কাগজ লিখে দিয়েছেন, ‘এইভাবে এইভাবে তুমি স্বীকারোক্তি দিবা। আর না হলে তোমাকে বাঁচায় রাখব না। যদি স্বীকারোক্তি না দাও, তাহলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে।’
“... আমি প্রথমবার দিতে চাইছিলাম না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডাক দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের আসামি তো ভালো করে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে না।’ তারপর উনারা আমাকে বাইরে নিয়ে গেছেন। বাইরে নিয়ে গিয়ে শাসিয়েছেন।...
“আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম, স্যার, আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে যেতে দেন। আমার ছোট ছোট ভাইয়ের জন্য আমার মনটা, প্রাণটা কাঁদছে। আমার মায়ের জন্য কাঁদছে। আমার মায়ের কাছে যেতে দেন। এইভাবে আকুতি করলাম।”

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহার করা এমন অনেক ঘরে আটকে রাখা হয় ধরে আনা ব্যক্তিদের। সরকার বদলের পর ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া এমন তিনটি বন্দিশালা ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
‘আগেই তৈরি স্বীকারোক্তি, করানো হয় মুখস্ত’
ভুক্তভোগীদের বরাতে গুম সংক্রান্ত কমিশন প্রতিবেদনে লিখেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের লিখিত স্বীকারোক্তি জোর করে মুখস্ত করানো হত। চাপের মুখে সেই স্বীকারোক্তি বারবার মহড়ার পর এমনভাবে প্রস্তুত করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নেওয়া হত, যেন স্বেচ্ছায় দেওয়া হচ্ছে।
সিটিটিসির হাতে ২০২৩ সালে গুমের শিকার একজন তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে কমিশনকে বলেছেন, “ওই বিভিন্ন জিনিস লেখাইছে, মুখস্ত করাইছে, বলছে এগুলি বলবি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে। নাইলে কিন্তু যতবার খুশি, ততবার আমরা রিমান্ড আনব।”
২০১৭ সালে অপহরণের পর র্যাবের হাতে ১১৩ দিন বন্দি থাকা একজনের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, “লাস্টের চার দিন সময় দিছে যে: ‘তোমারে চার-পাঁচ দিন সময় দিলাম, এটা মুখস্ত করবা... তুমি এই কথাগুলাই বলবা... যদি না বলো এগুলা, তা তোমারে পাঁচ-সাতটা মামলা দিয়া দিমু, আর যদি বলো, তাহলে তোমার একটা ছোট্ট মামলা দিয়া ছেড়ে দিমু’।”
সিটিটিসির হাতে ২০২০ সালে ৪৪ দিন গুম থাকা আরেক ভুক্তভোগীর বরাতে কমিশন লিখেছে, “আমাকে তারা আগে থেকেই ফরমেট সারারাত পড়াইছে, ‘এইটা এইটা বলবা।’ সকালবেলা আবার পড়াইছে, ‘কোর্টে যাবা, যা যা জিজ্ঞাসা করুক, তুমি এটাই বলবা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।’... ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি বলছি, স্যার, আমি একটু আপনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। ম্যাজিস্ট্রেটকে যখন আমি বলছি, স্যার, এগুলা আমি করি নাই। এরা আমারে মারধর করে, আমারে জোর করে এগুলা বলাই দিছে।
“ম্যাজিস্ট্রেট বলছে, ‘ঠিক আছে, আমি দেখতেছি।’ কিন্তু তারপরও সে এটা আমার বিপক্ষে লেখছে। কারণ, এতদিন আমারে গুম রাখছে, অন্য কোনোদিন কিন্তু তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনতে পারত না। [কিন্তু আসলে] যেদিন তাদের পছন্দের ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, সেদিনই তারা আমারে কোর্টে হাজির করছে।”

গুম তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে নির্যাতনের কায়দার এমন সব প্রতীকি ছবি ব্যবহার করেছে।
আইনি প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি
ভুক্তভোগীদেরকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের জন্য বারবার আদালতে হাজির করা হলেও আইনি প্রতিনিধিত্ব না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। আইনজীবী রাখার সুযোগ দেওয়া হলে এক্ষেত্রে আইন প্রতিপালনের সুযোগ তৈরি হত বলে কমিশন মনে করছে।
র্যাবের হাতে ২০১৯ সালে ১৩ দিন গুম থাকা একজনের বরাতে কমিশন লিখেছে, “তখন জজ সাহেব বলল, ‘তোমাদের কোনো উকিল আছে কিনা।’
“আমাদের গুম অবস্থায় সরাসরি ওখানে নিয়ে গেছে। কেমনে উকিল ধরব? বললাম, উকিল নাই।... তো জজ সাহেব চার দিনের রিমান্ড দিলেন।”
২০১৬ সালে ‘অপহরণের’ পর ডিজিএফআই এবং র্যাবের হাতে ৩১৫ দিন গুম থাকা এক ভুক্তভোগী কমিশনক বলেছেন, “কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘আপনাদের তো উকিল নাই, আপনাদের কিছু বলার আছে কিনা?’
“তখন আমরা বলছি, স্যার, আমাদের বলার আছে।... আমাদের এই রিমান্ড কীভাবে হবে, আমরা তো এখানে ছিলামই না। এইভাবে আমাদের যখন পুরো গুমের ঘটনা বর্ণনা করছি, তখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছে। উনি তখন বলছে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছ ‘।’”
এরপর বিচারকের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের কথোপকথনের বর্ণনা দিয়ে ওই ভুক্তভোগী বলেন, “উনি বলছে, ‘এই যে উনারা বলতেছে যে, উনাদেরকে গুম করে রাখা হয়েছে, তো আপনি তো বলতেছেন যে আপনারা গত পরশুদিনে উনাদেরকে গ্রেপ্তার করছেন, তাহলে এখন কি জবাব দেবেন?’
“তো তখন আমাদেরকে যে রিমান্ড চেয়েছিল, চট্টগ্রামের একজন পুলিশ কমিশনার, উনি বলছে, ‘উনারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত। ট্রেনিংপ্রাপ্ত না হলে কি এইভাবে বলতে পারে?’ কারণ বলতেছে, ‘ওরা যদি গুমে থাকে, তাহলে ওদের মোচ কাটা কেন? ওদের পরনে পরিষ্কার পোশাক কেন?’ অথচ মিডিয়াতে শো করার আগের দিন মোচ কেটে, পরিষ্কার পোশাক দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে।”
এরপরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওই ভুক্তভোগী বলেন, “পরবর্তীতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জু করে এবং বলে, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোন ধরনের নির্যাতন বা শারীরিক টর্চার ছাড়া রিমান্ড শেষ করতে হবে।’”

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম এবং সদস্যরা বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেন।
দুই সুপারিশ
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘গুম ও আয়নাঘরের’ বিষয়টি আবার সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে এসব ঘটনা তদন্তে গত ২৭ অগাস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের গুম তদন্ত কমিশন গঠন করে।
কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন ওই প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয়।
এরপর ৪ জুন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেয় কমিশন। সেখানে ‘গুমের’ শিকার ব্যক্তি এবং প্রত্যক্ষদর্শী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে নির্যাতান ও স্বীকারোক্তি আদায়ের সচিত্র বর্ণনা দেওয়া হয়।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া তিনটি গোপন বন্দিশালা ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। উপদেষ্টা পরিষদের সদন্য এবং গুম তদন্ত কমিশনের সদস্যরাও এসময় তার সঙ্গে ছিলেন।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামল কমিশনের বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
কমিশন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়ে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই বাছাই শেষে দ্বিতীয় প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
সেখানে বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট, বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব হলো—ভয়, পক্ষপাত, বিরাগ বা অনুরাগ ছাড়াই সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
“কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বিচার বিভাগ হাসিনা নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলো রোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও এই ঘটনাগুলো বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।”
অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কমিশন সরকারের কাছে দুটি প্রধান সুপারিশ রেখেছে। এর একটি ভবিষ্যতমুখী, অন্যটি অতীত সংশোধনের জন্য।
অতীত সংশোধনের জন্য ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে এক বছরের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রাখা এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হাজার হাজার সাজানো সন্ত্রাসবিরোধী মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে।
আর ভবিষ্যতমুখী সুপারিশে যুক্তরাষ্ট্রের শেখানো ‘নিরাপত্তাবাদী মডেল’ থেকে সরে এসে একটি ‘সামগ্রিক ও পুনর্বাসনমুখী’ সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা আরো কার্যকর ও টেকসইভাবে চরমপন্থার আদর্শগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো মোকাবিলা করবে।