
গাজার মতো ইরানেও নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। তাদের হামলায় নিহতদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। ইরানের সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরাইলের এ ‘অন্যায়’ হামলা মোকাবিলা করতে আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান।
সোমবার ইরানের পার্লামেন্টে এক বৈঠকে তিনি এই আহ্বান জানান। পেজেশকিয়ান বলেছেন, সঙ্ঘাত বন্ধের লক্ষ্যে ইরান ‘কূটনৈতিকভাবে সুযোগ দিয়েছে এবং আলোচনা ও সংলাপের পথ খুলে দিয়েছে’। ‘শত্রুরা হত্যা ও সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ইরান ও তার জনগণকে ধ্বংস করতে পারবে না। (ইরানের) আরো শত শত বীর আছেন, যারা প্রতিবার আক্রমণের শিকার হওয়ার পরও পতাকা বহন করবেন এবং পথচলা অব্যাহত রাখবেন’ বলেন পেজেশকিয়ান। ইরানের প্রেসিডেন্ট আরো বলেছেন, তার দেশ ‘পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চায় না’। তবে ইরানের ‘জনগণের উপকারে আসে এমন পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন ও গবেষণা করার অধিকার তাদের রয়েছে।’
এদিকে, ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আবার বোমা হামলার কয়েক ঘণ্টা পর তেল আবিব এবং হাইফাসহ ইসরাইলে নতুন করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে কমপক্ষে আটজন নিহত হয়েছে। ইরানের উপর ইসরাইলের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৪০ জনেরও বেশি হয়েছে, যার মধ্যে ৭০ জন নারী ও শিশু। রোববার ইসরাইলি হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের গোয়েন্দা প্রধান এবং আরো দুই জেনারেল নিহত হয়েছেন।
গত ৬৫ ঘণ্টায় ইসরাইলি হামলায় মোট এক হাজার ৪৮১ জন নিহত বা আহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার ২৭৭ জনকে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়-অনুমোদিত চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক, কেরমানপুর জানিয়েছেন। এদিকে ইরান, কাতার ও ওমানকে জানিয়েছে, ইসরাইলের চলমান হামলার মধ্যে তারা যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো আলোচনায় আগ্রহী নয়। রোববার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন আলোচনার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা।
বিদ্যুৎ অবকাঠামোয় হামলা, জ্বলছে হাইফা-তেল আবিব : ইসরাইলের তেল আবিব ও বন্দরনগরী হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চালিয়েছে ইরান। এতে ইসরাইলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছে ইসরাইল ইলেকট্রিক করপোরেশন (আইইসি)। রোববার দিবাগত রাতের ভয়াবহ হামলার পর স্থানীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে বিভ্রাট সৃষ্টি হয় এবং কিছু এলাকা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সিএনএন জানিয়েছে, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় হাসপাতাল, কমিউনিকেশন টাওয়ার ও গুরুত্বপূর্ণ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ জনগণকে খোলা তার বা বৈদ্যুতিক খুঁটির কাছাকাছি না যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে এবং জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট হেল্পলাইন নম্বরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছে। সোমবার ভোররাতে তেল আবিবের আকাশে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্রের দৃশ্য দেখা যায় এবং জেরুজালেমেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। হামলায় পাঁচ ইসরাইলি নিহত হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। হাইফায় ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার অভিযান চলছে। জরুরি বিভাগ জানিয়েছে, সেখানে প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছে। বন্দরের কাছে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। তেল আবিবের একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কয়েকটি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এই এলাকার মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরেই মার্কিন দূতাবাসের একটি শাখা অবস্থিত। দূতাবাস ভবনে কিছু ক্ষতি হলেও কেউ আহত হয়নি বলে জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
১০ ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত : ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী এক ঘণ্টার মধ্যে ১০টি ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি জানিয়েছে। একই সময়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’কে ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছে।
মাত্র এক ঘণ্টায় ইরানের বিভিন্ন এলাকায় ইসরাইলি হামলা ঠেকাতে ইরানের খাতাম আল-আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী ১০টি ইসরাইলি সামরিক বিমান গুলি করে ধ্বংস করেছে। এ তথ্য খাতাম আল-আম্বিয়ার এক কমান্ডারের বরাতে জানা গেছে। একই সময় তেহরানের ওপর ইসরাইলি হামলার পাল্টা জবাবে ইরান তেল আবিবের প্রতিরক্ষা সদর দফতরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করে ব্যাপক ধ্বংস সৃষ্টি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মানবে না কাতাইব হিজবুল্লাহ : ইরাকের কাতাইব হিজবুল্লাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইল-ইরান সঙ্ঘাতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার সতর্কতা দিয়েছে। ইরানের সমর্থিত এই সশস্ত্র গোষ্ঠী সরাসরি হুমকি দিয়েছে, যদি মার্কিন বাহিনী সঙ্ঘাতে দখল করে, তবে তারা অঞ্চলে আমেরিকান সেনাদের বিরুদ্ধে হামলা পুনরায় শুরু করবে। রোববার কাতাইব হিজবুল্লাহর সাধারণ সম্পাদক আবু হুসেইন আল-হামিদাউই এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা মার্কিন শত্রু বাহিনীর গতিবিধি খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি। যদি যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে, তবে আমরা তাদের স্বার্থ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ঘাঁটিগুলোকে সরাসরি লক্ষ্য করব।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সুরক্ষিত আছে : আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি ভিয়েনায় গভর্নর বোর্ডকে ইসরাইলের চলমান হামলার পর ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি আপডেট প্রদান করছেন। তিনি বলেছেন, নাতানজ বা ফোরডোর সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলোতে আরো কোনো ক্ষতির লক্ষণ নেই। সংস্থাটি ইরানে রয়েছে এবং থাকবে। ইরানের এনপিটি সুরক্ষা বাধ্যবাধকতার অধীনে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইরানে সুরক্ষা পরিদর্শন অব্যাহত থাকবে, তিনি বিবৃতিতে বলেছেন।
‘আয়রন ডোম’ থেকে আস্থা হারাচ্ছে সাধারণ ইসরাইলিরা : ইসরাইলি নাগরিকদের বড় অংশই নিজেদের অত্যাধুনিক ‘আয়রন ডোম বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে এত দিন ‘দুর্ভেদ্য’ বলে মনে করতেন। কিন্তু গত তিন দিনের ইরানি হামলায় তাদের সেই অনুভূতিতে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে, হামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ইসরাইলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আগের মতো আস্থা রাখতে পারছেন না। যদিও ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বহুস্তরযুক্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে ব্যবস্থাটি যে পুরোপুরি ‘নিখুঁত নয়’ সেটি অবশ্য স্বীকার করছেন কর্মকর্তারা।
মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত তুরস্ক ও রাশিয়া : ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে গত চারদিন ধরে যে পাল্টা-পাল্টি হামলা চলছে, সেটি বন্ধে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ দেখিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েপ এরদোগান। উভয়ই আলাদাভাবে জানিয়েছেন, সঙ্ঘাত বন্ধের লক্ষ্যে তারা মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
‘সঙ্ঘাত নিরসনের জন্য রাশিয়ার আগের প্রস্তাব এখনো বহাল রয়েছে। যদিও পরিস্থিতি এখন আরো জটিল হয়ে পড়েছে’ বলেছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। সমস্যার সমাধানে রাশিয়া বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলেও জানিয়েছে ক্রেমলিন। এদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এরদোগান সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ইসরাইলের সাথে সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাতে তুরস্ক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনে প্রস্তুত বলে ইরানকে জানিয়েছেন এরদোগান।
পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ইরানের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত পাকিস্তান : ইসরাইল-ইরানের যুদ্ধে সরাসরি ইরানের প্রতি সমর্থনের বার্তা দিয়েছে পাকিস্তান। এবার ইরানের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে বিস্ফোরক দাবি করলেন ইরানের এক শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা। তার দাবি, পাকিস্তান তাদের জানিয়েছে, যদি ইসরাইল ইরানের উপর পরমাণু হামলা করে তাহলে পাল্টা ইসরাইলের উপর পরমাণু হামলা চালাবে পাকিস্তান। টার্কি টুডের প্রতিবেদনে ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের সিনিয়র জেনারেল এবং ইরানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য মহসিন রেজাইকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। মহসিন বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমাদের জানিয়েছে যদি ইসরাইল আমাদের উপর পরমাণু বোমা ফেলে, তাহলে ওরাও ইসরাইলকে পরমাণু অস্ত্র দিয়ে হামলা করবে।’
তেল আবিবের মার্কিন দূতাবাস ক্ষতিগ্রস্ত : ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি জানিয়েছেন, ইরানের রাতভর হামলায় তেল আবিবের মার্কিন দূতাবাস ‘সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। মাইক হাকাবি এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে বলেছেন, তেল আবিবে দূতাবাস ভবনটির আশেপাশে ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানায়’ ভীষণ কম্পনে কনস্যুলেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো মার্কিন কর্মী হতাহত হননি বলে তিনি জানান। এ কারণে জেরুজালেমে অবস্থিত প্রধান মার্কিন দূতাবাসও বন্ধ থাকবে এবং এখনো সেখানে নিরাপদে অবস্থান করার নির্দেশনা বহাল আছে। সূত্র : তেহরান টাইমস, রয়টার্স, বিবিসি, আল-জাজিরা।