
শক্রমুক্ত ইসরাইল
ইসরাইলের সামনে আর কোন শত্রু থাকল না। ইরান হয়ত মুখরক্ষা পাল্টা-হামলা চালাবে, এতে ইসরাইলের বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চতুর্দিক হতে ইসরাইল প্রায় শত্রুমুক্ত। অথচ এককালে ইসরাইল চতুর্দিকে শত্রুঘেরা ছিল। দেশটি তিন তিনবার সম্মিলিত আরব বাহিনীকে পরাজিত করেছে, ১৯৪৮-৪৯. ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে। তারপর থেকে ইসরাইলের লাগোয়া তিন আরব দেশ মিশর, জর্দান ও সিরিয়া সশস্ত্র লড়াইয়ের পলিসি বাদ দিয়েছে। মিশর ও জর্দান ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে এবং অতি সতর্কতার সাথে তা মেনে চলে, পাছে ইসরাইল নাখোশ হয়। সিরিয়ার সাথে চুক্তি না হলেও দেশটি ইসরাইলের সাথে শত্রুতা করার মত অবস্থায় নেই। লেবাননে কখনো কার্যকর সরকার ছিল না। তাই উত্তরে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ নেই।
আরব দেশগুলোর পরাজয়ের পর ইসরাইলের হুমকি ছিল ফিলিস্তিনি সশস্ত্র আন্দোলনগুলো। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি হওয়ার পর ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর প্রতিরোধ (পিএলও) হতে ইসরাইল মুক্তি লাভ করে। অবশিষ্ট রইল সশস্ত্র ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন: পশ্চিম তীর ও গাজায় হামাস ও ইসলামিক জিহাদ। ফিলিস্তিনের বাইরে লেবাননে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ এবং দূর ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি। হাসান নাসরাল্লাহ ও তার ডেপুটিকে হত্যার পর হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ-সক্ষমতা হ্র্রাস পেয়েছে বা অবলুপ্ত হয়েছে। হামাসকে নির্মুল করতে গিয়ে ইসরাইল গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। ওদিকে দূরের হুথির আক্রমণে ইসরাইলের চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। প্রতিটি প্রতিরোধ আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক ইরানে বিধ্বংসী হামলার পরে ইসরাইল আশা করতে পারে যে, রাষ্ট্রীয় এবং সাংগঠনিক প্রতিরোধ থেকে ইসরাইল মুক্তি লাভ করেছে। তার মানে সামনে পুরো ময়দান সমান ও ফকফকে সাদা।
পর্যুদস্ত ইরান
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবরোধে ইরান বহু বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত, অনেকটা পণ্য বিনিময় প্রথার মাধ্যমে দেশটি আমদানি-রপ্তানি করে। রেজিমকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জনগণের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য হোক বা আন্তরিকভাবেই হোক, দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া গ্রুপগুলোকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল ইরান। সিরিয়ার আসাদ-রেজিম এক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। তার পতনের পর ইসরাইলের কাছাকাছি কোন এলাকায় ইরানের সামরিক উপস্থিতি দূরূহ হয়ে পড়ে। এমন সময় যুক্তরাষ্ট্রে ডোলাল্ড ট্রাম্পের মত ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আন্তর্জাতিক আইন-কানুন ও রীতিনীতির প্রতি যার বিন্দুমাত্র সম্মান নেই। নেতানিয়াহু এ মোক্ষম সুযোগটি গ্রহণ করল। ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও তাকে ইরান হামলায় প্ররোচণা জুগিয়েছে। গতকাল নেতানিয়াহু মাত্র ১ ভোটে সরকারের পতন ঠেকাতে সক্ষম হয়। এ সময় তার জনসমর্থন বাড়ানোর প্রয়োজন, ইরানে হামলার চেয়ে জনসমর্থন বৃদ্ধিকারী কোন টনিক নেই। যা হোক্ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ইসরাইল তার ইতিহাসের সবচেয়ে নিরাপদ ও শত্রুহীন ক্ষণে উপনীত হয়েছে।
নির্ভার আরব
ইসরাইলের ইরান-হামলায় আরব রাজারা বেজার হয়েছেন, এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। এটা সত্য, আরব দেশগুলোর শিয়া জনগোষ্ঠী ইরানি প্রেষণায় উজ্জীবিত, তাদের দিক থেকে আরব রাজারা সব সময় হুমকি অনুভব করে। আরবদের আস্থা অর্জন করতে না পারা ইরানের ব্যর্থতা নিশ্চয়। ইসরাইলের বিধ্বংসী হামলার পর কয়েকটি আরব রাষ্ট্র মুখে মুখে ইসরাইলের সমালোচনা করলেও মনে মনে ব্যাপক আনন্দিত, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে তাদের এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য।
অন্ধকার ফিলিস্তিন
গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, প্রায় ষাট হাজার নারী-শিশু নিহত। গাজায় প্রাণের কিছুই নেই। বিপদ এখানে শেষ নয়, ইসরাইলি অর্থমন্ত্রী চরম উগ্রবাদি স্মট্রিস ফিলিস্তিনি ব্যাংকগুলোর সাথে সহযোগিতা বন্ধ করার আদেশ দিয়েছেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরের ব্যাংকগুলোর বাইরের দেশের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ নেই। ইসরাইলের এ পদক্ষেপের অর্থ হল পশ্চিম তীরকে আর্থিকভাবে ধ্বংস করা। ইসরাইলি পার্লামেন্ট পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছে, পশ্চিম তীরকে সরকারি কাগজপত্রে বাইবেলিয় নামে অভিহিত করার আইন পাশ হয়েছে। গাজার পর ধীরে ধীরে পশ্চিম তীর দখল করার পায়ঁতারা করছে ইসরাইল। গাজা ও পশ্চিম তীর দু’টোই বৃহৎ কারাগার। কারাগারে বন্দি মানুষের আত্মীয়-স্বজন ব্যবস্থা না নিলে তাদের মুক্তির কোন উপায় থাকে না। ফিলিস্তিনিদের জন্য আক্ষরিক অর্থে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ নেই।
কী হতে পারে ভবিষ্যতে
ইরানি রেজিমের কি পতন হবে? না, এ বিষয়ে মন্তব্য করা খুব অগ্রিম হবে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইরান দুর্বল হয়ে পড়বে, এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার অনুসারি গ্রুপগুলোকে সহায়তার সক্ষমতা কমে যাবে। আরব দেশগুলো সাময়িকভাবে আনন্দিত হতে পারে, এই ভেবে যে, তাদের দেশের শিয়াদের উৎপাত কমে যাবে।
তবে আরবদের ভয়ের কারণও আছে। নেতানিয়াহু যে পদ্ধতি অবলম্বন করছে, তা ইসরাইলে উগ্রতা বৃদ্ধি করবে, যার ফলে লিকুদ নয়, বেন গাভির ও স্মট্রিসের দল শক্তিশালি হতে পারে। এদের পরিকল্পনা গাজা ও পশ্চিম তীরে সীমাবদ্ধ নয়, তাদের বৃহৎ ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নে জর্দান, সিরিয়া ও সৌদি আরবের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত। আরব দেশগুলো যেভাবে ইসরাইলের সামনে আত্মসমর্পণ করেছে, যেভাবে নেতানিয়াহু যা খুশি তা করে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো অগ্রসর হলে, কার কী বলার আছে?
এটি একটি দূর সম্ভাবনা, উগ্রবাদের উত্থান ইসরাইলকে শক্তিশালি করার পরিবর্তে ভেতর থেকে দুর্বলও করে দিতে পারে। উগ্রবাদি রাষ্ট্রে অনেক ইহুদি হয়ত বসবাস করতে চাইবে না, বিশেষত ইউরোপীয় ও আমেরিকান ইহুদিরা। তাই এখনই এটি নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে, ইসরাইল উগ্রবাদে আত্মসমর্পণ করলে বর্ধিত হবে, না ক্ষয়িষ্ণু হবে।
ফিলিস্তিনের কি হবে? আবরাহার কাছে আবদুল মুত্তালিবের ছাগল ভিক্ষা চাওয়ার মত অবস্থা। আমার বাড়ি দখলে নিয়েছে দস্যুরা, তাই বলে তারা কি আমার বাড়ির মালিক? ইসরাইল নামে কোন রাষ্ট্র নেই। ফিলিস্তিন দখলে নিয়েছে কিছু দস্যু। দুনিয়া শক্তিতে চলে, তাই শক্তি অর্জন করে বাড়ি পুনরুদ্ধার করতে হবে। যতদিন না তা হচ্ছে ততদিন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শিখিয়ে যেতে হবে, ‘ফিলিস্তিন আমার বাড়ি, দখলদারকে হটিয়ে ওখানে আমি ফিরে যাব।’ ইসরাইলের প্রাণভোমরা যেখানে, সেই আমেরিকার দুর্বলতা ইসরাইলের পতন তরান্বিত করতে পারে। ট্রাম্প যা পাগলামি শুরু করছে, তার আমলেই যদি আমেরিকা দুর্বল হতে শুরু করে, তা মন্দ হয় না। ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণেও ভেতর থেকে রাষ্ট্রটি দুর্বল হতে পারে। মুসলিমদের এ যুগের ঘুমন্ত প্রজন্মকে হয়ত আল্লাহ তাআলা তাঁর ইনসাফ দেখার সুযোগ দেবেন না।
এহসান যুবায়ের হক