
.
১. ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫% ভোট পেয়ে আসন পায় ২১০টি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ৪০% ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৬২টি। ২০০৮-এর নির্বাচনেও অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ৪৮% ভোট পেয়ে ২৩০ টি আসন পায়। অপরদিকে ৩২.৫% ভোট পেয়ে বিএনপি জোট পায় মাত্র ৩০টি আসন। বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় একটু এদিক-ওদিক করলেই প্রধান দলগুলোর কোন একটিকে অর্ধেকেরও কম ভোট পেয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইয়ে দেয়া যায়।
.
২. দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু আসনে ৫-১০ শতাংশ ভোট কম-বেশি করা গেলে কোন দলকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইয়ে দেয়া যায়। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এই কাজটি করা কঠিন নয়। যেমন সংসদীয় আসনের সীমানা পুন:নির্ধারণ করে কাউকে হারিয়ে দেয়া বা জিতিয়ে আনা যায়, যদি তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বীর সাথে জনসমর্থনের পার্থক্য কম থাকে। স্থানীয় শক্তিশালীদের প্রভাব খাটিয়ে, ভোটারদের ভয় দেখিয়ে, টাকা ছড়িয়ে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে এই পরিমাণ প্রভাবিত প্রভাবিত করা যায়, যাতে ৫-১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধান ঘটানো যায়।
.
৩. উপরে উল্লিখিত এক বা একাধিক পন্থাকে ব্যবহার করে কোন দল বা জোটকে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাইয়ে দেয়া অসম্ভব নয় এবং একবার ব্রুট মেজরিটি পেলে সেই দল বা জোট সংবিধানে কাটাছেড়া করতে দ্বিধা করে না।
.
৪. সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, এই ধরণের ঘটনা ঘটলে দেশের সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি - কাউকেই তেমন প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। ক্ষমতাশীনদের প্রতি দেশের উচু শ্রেণী সব সময় শর্তহীন আনুগত্য করে আসছে। বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে সমাজের উপরতলার মানুষের দুর্বল আত্মসম্মান বা নৈতিকতা বোধ স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেখা গেছে সমাজের অনেক বিখ্যাত মানুষ অবলীলায় দলটির নেত্রীর তোষামোদি করেছে শুধুমাত্র পদ-পদবীর লোভে। একই ঘটনা অন্য সময়েও দেখা গেছে। ফলে, নির্বাচন কমিশনের মত খুবই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিদের মেরুদন্ড খাড়া করে দাড়াতে খুব কম সময়েই দেখা গেছে।
.
৫. ফলে, আজ যতই সংস্কার করে রেখে যান, একবার স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসতে পারলে সব বদলে ফেলতে তাদের সময় লাগবে না। এ কারণে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে স্বৈরতন্ত্র আর কখনোই জেঁকে বসতে না পারে।
.
৬. উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসার প্রধান কারণ হচ্ছে, নির্বাচন ব্যবস্থায় জনমতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটানোর ব্যবস্থা না থাকা। যেহেতু ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট পেলে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়া যায়, তাই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর নানাবিধ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হয়। যেহেতু মূল সমস্যাটা হচ্ছে, সংসদে জনগণের সঠিক প্রতিফলন না ঘটা, অল্প ভোট পেয়ে বেশি আসন পাওয়া, তাই এর থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে ভোটের অনুপাতে সংসদীয় আসন সংখ্যা নির্ধারণ। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জনসমর্থনের (ভোটের) অনুপাতে আসন বন্টন করা হলে সংসদে জনমতের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে। সেক্ষেত্রে কোন দলের পক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নিয়ে ইচ্ছেমত সংবিধানে কাটাছেড়া কো সম্ভব হবে।
.
৭. যেহেতু এদেশের মানুষ ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে অভ্যস্থ, স্থানীয় সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নে সংসদ সদস্যদের ঐতিহ্যগত ভূমিকা রয়েছে, তাই পুরোপুরি আনুপাতিক ব্যবস্থা চালু কঠিন। এই ব্যবস্থা প্রধান দলটি মানতেও চাইবে না। তাই নিম্নক্ষকে বর্তমানের মত রেখে উচ্চ কক্ষে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বন্টন করা।
.
৮. উচ্চকক্ষের আসনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন নিবে। তাতে একদিকে যেমন জনমতের প্রতিফলন ঘটবে, তেমনি সংসদে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মানুষের জন্য স্থান করা যাবে।
.
৯. নিম্নকক্ষের কাজ হবে বাজেট অনুমোদন, সরকারি অর্থ নিয়ন্ত্রণ, বাজেট বাস্তবায়ন পর্যালোচনা ইত্যাদি। জনপ্রতিনিধিরা এলাকার সমস্যা নিম্নকক্ষে আলোচনা করবেন।
.
১০. উচ্চকক্ষের কাজ হবে প্রস্তাবিত আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং রাষ্ট্রকে নীতি নির্ধারণী বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া। উচ্চ কক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোন আইন পাশ হবে না এবং এই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের অনুমোদন ছাড়া সংবিধানে কোন সংশোধন করা যাবে না।
.
১১. সংসদীয় কমিটিগুলো উভয় কমিটি থেকে সদস্য নিয়ে গঠিত হবে।
.
১২. রাষ্ট্রপতি, উচ্চ আদালতের বিচারক এবং সাংবিধানিক পদে নিয়োগের মত বিষয়গুলো উচ্চকক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এভাবে উভয় কক্ষের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে।
.
প্রচলিত ব্যবস্থায় যে পরিমাণ চুরি হয়, তার হাজার ভাগের এক ভাগ ব্যয় করে দ্বিকক্ষ চালু করা সম্ভব। হাসিনার পনের বছরে চৌত্রিশ লক্ষ কোটি টাকা শুধু পাচারই হয়েছে। উচ্চকক্ষের দুইশত সদস্যের প্রত্যেকের জন্য মাসে দশ লাখ টাকা খরচ হলেও বছরে ২৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।