
দুটি বহু পুরোনো এবং মুসলিম জীবনের সাধারণ অনুষঙ্গ হালাল মাংস ও বোরকা পুনরায় যুক্তরাজ্যের মূলধারার রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে। সম্প্রতি দেশটির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিষয় দুটি নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা ব্রিটিশ মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাজ্যে হালাল মাংস ও বোরকা বহুদিন ধরেই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রতীক ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিভাজন এই প্রথাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। মুসলমানরা আশঙ্কা করছেন, ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে প্রতিষ্ঠিত অধিকারগুলো যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, তাহলে তা কেবল একটি সম্প্রদায় নয়, বরং গোটা ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সহনশীলতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা বনাম পশু কল্যাণ বিতর্ক
সোমবার (৯ জুন ২০২৫) হাউজ অব কমন্সে একটি গুরুত্বপূর্ণ ই-পিটিশনের ওপর বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই পিটিশনে অজ্ঞান না করে পশু জবাই নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এতে এক লাখের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। যুক্তরাজ্যের বর্তমান আইনে ধর্মীয় কারণে, বিশেষ করে মুসলিমদের হালাল ও ইহুদিদের শেচিতা প্রথার ক্ষেত্রে অজ্ঞান না করেই পশু জবাইয়ের অনুমতি আছে।
তবে পশু অধিকারকর্মীদের মতে, অজ্ঞান না করে জবাই করা নিষ্ঠুর। এটি ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের একটি সাম্প্রতিক রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওই রায়ে বলা হয়েছে, অজ্ঞান না পশু জবাইয়ে নিষেধাজ্ঞা ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন করে না।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যের ৮৮ শতাংশ হালাল মুরগি এবং বেশিরভাগ হালাল গরুর মাংস অজ্ঞান করেই জবাই করা হয়। তবে তা ইসলামি বিধান অনুযায়ী অনুমোদিত পদ্ধতিতেই। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখিয়েই পশু কল্যাণ বজায় রাখা। তাই ডেমোনস্ট্রেশন অব লাইফ প্রোটোকল-এর মতো শিল্পনির্ভর উদ্যোগে সরকারের সমর্থন রয়েছে।
এদিকে, মাংসজাত পণ্যে জবাইয়ের পদ্ধতি লেবেলিং বাধ্যতামূলক করার দাবিও জোরালো হচ্ছে। এর পেছনে মূলত হালাল খাদ্য নিয়ে বাজারে জালিয়াতির উদ্বেগ আছে। সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় দেখা গেছে, কার্ডিফে এক বিক্রেতা হালাল হিসেবে ভুয়া মাংস বিক্রির জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
বোরকা বিতর্ক ও রাজনৈতিক বিভাজন
বোরকা নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিতর্কটি সামনে এনেছে রিফর্ম ইউকে পার্টি। দলটির একাধিক এমপি ইউরোপের কিছু দেশের উদাহরণ টেনে যুক্তরাজ্যেও মুখঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ নিয়ে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁছায়। এর ফলে দলীয় চেয়ারম্যান জিয়া ইউসুফ পদত্যাগ করেন। যদিও পরে তিনি ফের দলে যোগ দেন। কনজারভেটিভ দলের প্রভাবশালী নেতারাও বোরকা নিষিদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
রিফর্ম ইউকের অন্যতম মুখপাত্র নাইজেল ফারাজ ও লি অ্যান্ডারসন এই অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের মতে, জননিরাপত্তার স্বার্থে মুখ খোলা থাকা জরুরি।
অন্যদিকে, লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার স্পষ্ট করেছেন যে, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত পছন্দ তাদের মূলনীতি এবং তারা কোনও ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেন না।
ধর্মীয় অধিকার রক্ষাকারীরা বলছেন, নারীর পোশাক বাছাইয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অসাংবিধানিক, ইসলামভীতি উসকে দেওয়া এবং ধর্মীয় বৈষম্যের শামিল। অনেক ইসলামিক চিন্তাবিদও বোরকাকে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় পোশাক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন না। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে কোনও জাতীয় পর্যায়ে মুখ ঢাকার ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। যদিও নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মুখ খোলার প্রয়োজন হতে পারে।
পুরোনো ইস্যুতে নতুন বিতর্ক কেন?
যুক্তরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতাদের মতে, এই দুই বিষয়ে হঠাৎ করে বিতর্ক তৈরি হওয়া রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ। রিফর্ম ইউকের মতো ডানপন্থি দলগুলো ব্রিটিশ মূল্যবোধের নামে মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে লক্ষ্য করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের ইস্যু খুঁচিয়ে তোলার উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট একটি ভোটব্যাংককে তুষ্ট করা এবং বহুসংস্কৃতিবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সংবাদমাধ্যমেও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে এই বিতর্ককে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হালাল মনিটরিং কমিটি (এইচএমসি) বলছে, অজ্ঞান না করে জবাই নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে মুসলমানদের বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর প্রভাব
২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ৬ শতাংশ মানুষ মুসলিম। সংখ্যায় যা প্রায় ৪০ লাখ। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। এর অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম যুক্তরাজ্যেই জন্মেছেন এবং ৭৫ শতাংশ নিজেকে কেবল ব্রিটিশ পরিচয়ে পরিচিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। মুসলিমরা দেশটির দ্রুততম বর্ধনশীল সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।
ব্রিটিশ বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় মুসলমানরা মুসলিম জনসংখ্যার বড় অংশ। এই জনগোষ্ঠী বোরকা ও হালাল বিতর্ককে তাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। দীর্ঘদিন ধরে গ্রহণযোগ্য এই প্রথাগুলোর ওপর নতুন করে সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ তাদের দাদা-দাদিদের প্রজন্মের বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ইসলামভীতি ও বৈষম্যের বাস্তবতা
মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন (এমএবি) জানায়, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ডানপন্থি উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের পর ইসলামভীতি নতুন করে বেড়েছে।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূতসহ মুসলমানরা চাকরি, আবাসন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। দারিদ্র্যের সঙ্গেও এই বৈষম্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ৩৯ শতাংশ মুসলিম সবচেয়ে দরিদ্র এলাকায় বাস করেন। এই দরিদ্র এলাকাগুলো প্রায়শই জাতিগতভাবে ঘনবসতিপূর্ণ।