
ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশেষে স্বীকার করেছেন যে, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার দেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহায়তা করছে।যাদের অনেকেই ‘অপরাধী গ্যাং’ হিসেবে পরিচিত এবং যাদের বিরুদ্ধে ত্রাণ ট্রাক থেকে খাদ্য ও ওষুধ লুটের অভিযোগ রয়েছে।
নেতানিয়াহু এই স্বীকারোক্তি এমন এক দিনে দিলেন, যেদিন ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলায় আরও ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় নেতানিয়াহু বলেন, ‘নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পরামর্শে আমরা গাজার ভেতরে হামাসের বিরুদ্ধে কিছু শক্তিশালী স্থানীয় গোত্র বা পরিবারকে সক্রিয় করেছি’।
এর মাধ্যমে দখলদার ইসরাইল সরকার প্রথমবারের মতো স্বীকার করল যে, তারা গাজায় এমন কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যাদেরকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘অপরাধী’ আখ্যা দিয়ে আসছে।
ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান এর আগেই একই অভিযোগ তুলেছিলেন। তার কয়েক ঘণ্টা পর নেতানিয়াহু নিজেই স্বীকার করলেন বিষয়টি।
কোন গোষ্ঠীগুলো জড়িত?
এপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তথাকথিত ‘পপুলার ফোর্সেস’। যার নেতৃত্বে রয়েছেন রাফাহ এলাকার গোত্র নেতা ইয়াসের আবু শাবাব।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ১০০ এবং তারা গোপনে ইসরাইলি বাহিনীর অনুমোদনেই কাজ করছে। প্রতিবেদনে গোষ্ঠীটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে ‘অ্যান্টি-টেরর সার্ভিস’।
সম্প্রতি এই আবু শাবাব গোষ্ঠী ঘোষণা দেয় যে, তারা গাজায় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ও ইসরাইল পরিচালিত সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রগুলো রক্ষা করছে।যেগুলো পরিচালিত হচ্ছে রহস্যময় গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর মাধ্যমে।
ইসরাইলের ভেতরেই বিরোধ
এ ঘটনার পর ইসরাইলের ভেতরেই তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আল জাজিরার আম্মান প্রতিনিধি হামদা সালহুত বলেন,
‘ইসরাইলের বিরোধী দল বলছে, সরকার বা মন্ত্রিসভা কোনো আলোচনার মধ্য দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়নি। গাজায় অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে ইসরাইলি অস্ত্র তুলে দেওয়া অগ্রহণযোগ্য।’
‘মানব কসাইখানা’
এদিকে জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোতে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ১০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। ইসরাইলি সেনারা গত এক সপ্তাহে চারবার এসব কেন্দ্রের কাছে ত্রাণের জন্য জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার সাবেক মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেন, ‘এই ত্রাণ ব্যবস্থা গাজাকে এক ‘মানব কসাইখানায়’ পরিণত করেছে।এখানে মানুষকে পশুর মতো ঘিরে রেখে হত্যা করা হচ্ছে।’
এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ইসরাইলি হামলায় আরও ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
এরমধ্যে খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে এসেছে ৩১টি মৃতদেহ।গাজা শহরের আল-আহলি আরব (ব্যাপ্টিস্ট) ও আল-শিফা হাসপাতালে এসেছে আরও ২১টি।
এছাড়াও হামলায় ৪ জন সাংবাদিকও নিহত হয়েছেন, যারা আল-আহলি হাসপাতালের কাছে ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
গাজা সিটির বাসিন্দা ফাদি আল-হিন্দি আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমার সন্তানদের খোঁজে তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি- একজন বাইসাইকেল আরোহীর শরীর দ্বিখণ্ডিত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। রাস্তাজুড়ে রক্ত আর আহত মানুষ। আমরা আহতদের শরীরের টুকরো জড়ো করতে থাকি।’
এ হামলায় কমপক্ষে ৩ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।
হামাসের অবস্থান
এদিকে হামাস নেতা খলিল আল-হাইয়া এক রেকর্ড করা বক্তব্যে জানান, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং কিছু সংশোধন চেয়েছেন, যেন যুদ্ধ শেষ করা যায়।
তিনি বলেন, হামাস আলোচনায় আগ্রহী এবং মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
ইসরাইল গত মার্চে একটি অস্থায়ী অস্ত্রবিরতি ভেঙে গাজায় আবার হামলা শুরু করে।গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি হামলায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫৪,৬৭৭ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,২৫,৫৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
তবে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস তাদের মৃতের সংখ্যা ৬১,৭০০-এরও বেশি বলে উল্লেখ করেছে। জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষ মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মূলত নেতানিয়াহুর স্বীকারোক্তি ও ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা গাজার বিপর্যয়কর মানবিক পরিস্থিতিকে আরও চরমে পৌঁছে দিচ্ছে।এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরব থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যে গাজা যুদ্ধ থামানোর পথ এখন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।