Image description
 

আফ্রিকার দেশ মরক্কোতে এ বছর ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি না দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে দেশটির সরকার, যা রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

দেশজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, কৃষিখাতে ব্যাপক দুর্দশা এবং খরার কারণে পশুসম্পদের মারাত্মক ঘাটতির প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বুধবার (০৪ জুন) সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।

 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঈদুল আজহা মুসলিমদের জন্য একটি পবিত্র ধর্মীয় উৎসব, যেখানে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করে থাকেন। মরক্কোতেও প্রতি বছর লাখো মানুষ এই কোরবানির আয়োজন করেন। তবে ২০২৫ সালের ৭ জুন উদযাপিতব্য ঈদ এবার সেই চিরাচরিত রূপ হারাচ্ছে।

 
 

প্রসঙ্গত, গত সাত বছর ধরে মরক্কো চরম খরার মধ্যে রয়েছে। এর ফলে দেশের পশুসম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩৮ শতাংশ কমে গেছে। এই ঘাটতির কারণে পশুর দাম বেড়ে গিয়েছে অস্বাভাবিক হারে- গত বছর একটি সাধারণ ভেড়ার দাম গড়পড়তায় ৬০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছায়, কেজিপ্রতি প্রায় ৭ থেকে ৭.৫ ডলার।

 

অন্যদিকে, দেশের ন্যূনতম মাসিক মজুরি মাত্র ৩১০০ দিরহাম (৩৩৫ ডলার), যা সাধারণ মানুষের জন্য কোরবানির পশু কেনাকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।

দেশটির চলমান সংকট বিবেচনায়, রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ ফেব্রুয়ারিতে এক চিঠির মাধ্যমে ঘোষণা দেন- এই বছর সাধারণ জনগণ কোরবানি থেকে বিরত থাকবে এবং তিনি দেশের পক্ষ থেকে ঈদের কোরবানি সম্পন্ন করবেন।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এই কঠিন পরিস্থিতিতে কোরবানি পালন অনেক মানুষের জন্য কষ্টকর ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য।

এই সিদ্ধান্ত ১৯৬০-এর দশকের পর প্রথমবার রাজকীয়ভাবে কোরবানি বাতিলের ঘটনা, যখন মরহুম রাজা হাসান দ্বিতীয় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ জাদরি মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির কারণ হবে। পশু কেনার চাপ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। গত বছর অনেকেই উচ্চমূল্যে পশু কিনে আর্থিক সংকটে পড়েছিল, তিনি জানান।

এদিকে দেশটির এই সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খামারিরা, বিশেষ করে যারা ঈদ মৌসুমে পশু বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সাধারণত প্রতি ঈদে মরক্কোয় প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার পশু কোরবানি করা হয়।

সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় ৭০০ মিলিয়ন দিরহাম (৭৬.৫ মিলিয়ন ডলার) বাজেট ঘোষণা করেছে। ৫০ হাজার খামারির ঋণ মওকুফ, গর্ভবতী গবাদি পশুর নিবন্ধন, এবং নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ প্রদানের কথাও জানানো হয়েছে।

ঈদের আগে সুপারমার্কেটে সাধারণত যেসব ঈদসামগ্রী (ছুরি, বারবিকিউ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) বিক্রি হতো, সেগুলোর প্রচার-প্রচারণা এবার অনেকটাই অনুপস্থিত। মনে হচ্ছে না ঈদ আসছে, বলছেন বেনস্লিমানে বসবাসকারী এক গ্রাহক।

তবে অনেকেই মনে করছেন রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর এই সিদ্ধান্ত মানবিকতা ও ইসলামের মূল শিক্ষা—সহানুভূতি ও সমতা—প্রকাশ করে। ফাতিমা নামের এক রাবাতবাসী বলেন, এটি এক দারুণ বার্তা যে, ধর্মীয় মূল্যবোধ কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জনগণের কষ্ট বোঝার মধ্য দিয়েও প্রকাশ পায়।

যদিও বেশিরভাগ মানুষ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন, কিছু বিত্তবান পরিবার কোরবানি দিচ্ছে, যা সামাজিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করছে। অনেকেই গোপনে সরকারি অনুমোদিত স্লটারহাউসে কোরবানি করছেন এবং কিছু বাজারে অতিরিক্ত নজরদারি আরোপ করা হয়েছে।

অন্যদিকে, কেউ কেউ সমাজে সমতা বজায় রাখতে নিজেদের কোরবানির মাংস গরিবদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন।

এই ঘটনা মরক্কোর অর্থনৈতিক বৈষম্যও নতুন করে সামনে এনেছে। অক্সফামের ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে দেশটি উত্তর আফ্রিকায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ক্রমিক স্থানে ছিল আয়বৈষম্য হ্রাসে (মাত্র ৭৩ পয়েন্ট)।

মরক্কোতে এ বছর ঈদুল আজহা এক ভিন্ন আবহে পালিত হতে যাচ্ছে। কোরবানি না হলেও ঈদের নামাজ, পারিবারিক মিলন ও সাহায্য-সহানুভূতির চর্চার মাধ্যমে মানুষ ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করছে।