Image description
 

গত বছরের শেষ দিকে হওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক গুরুতর তথ্য জানলেন। আর তা হলো- তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন চীনা হ্যাকারদের আক্রমণের ঝুঁকিতে। এর আগেও ইরানি হ্যাকাররা তার নির্বাচনী প্রচারণা দলের ই-মেইল হ্যাক করেছিল। যদিও লেখালেখি অপছন্দ হওয়ার কারণে ট্রাম্প খুব একটা উদ্বিগ্ন হননি।

 

কিন্তু ২৫ অক্টোবর মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাতেই ঢুকে পড়েছে  হ্যাকাররা। এতে ট্রাম্প, জে ডি ভ্যান্সসহ বহু রাজনীতিবিদের গোপন কথোপকথন হুমকির মুখে পড়ে।

আর এ খবর শুনে তার দলের কেউ কেউ নিজের হাতে থাকা ফোনটাই ফেলে দেন। কেউ পুরোনো নাম্বার বাদ দেন, কেউবা সিগন্যালের মতো নিরাপদ অ্যাপে যোগাযোগ শুরু করেন। তবে ট্রাম্প একেবারেই নির্লিপ্ত। 

ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, বহু বছর ধরেই তাকে সতর্ক করা হচ্ছিল, কিন্তু পুরোনো আইফোনেই অটল ছিলেন তিনি। বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগে সেটি ছাড়া তিনি থাকতে চান না।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের গুরুত্ব টের পাওয়া গেছে। এক উপদেষ্টা জানান, ক্ষমতালাভের পরদিন ভোরে ট্রাম্প বলছিলেন, ‘বিশ্বাস করবে না, বিশজন বিশ্বনেতা আমাকে ফোন করেছে! সবাই যেন আমার মন জয় করতে চাইছে!’

সঙ্গে থাকা ফোনটিই এখন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। আইনপ্রণেতা, আত্মীয়, বন্ধু, ব্যবসায়ী, তারকা, এমনকি সাংবাদিকরাও সরাসরি তাকে ফোন করেন। কারণ সবাই জানেন যে, ফোনটা তিনিই ধরেন, পাশে কোনো সহকারী থাকেন না। এমনকি অপরিচিত নম্বর থেকেও কল এলে রিসিভ করেন ট্রাম্প। 

এই যেমন নিউ জার্সিতে এক সকালে কল রিসিভ করেই ট্রাম্প প্রশ্ন করছিলেন, ‘কে বলছেন?’ কারণ ফোনের ওপাশে যে কেউ থাকতে পারতো।

ট্রাম্প ফোনে কথা বলতে ভালোবাসেন, অপরিচিত কল ধরতেও আগ্রহী। অচেনা নম্বর থেকে কল এলে তা তার কাছে যেন একটা চমক! একটা গাম বল মেশিনে কয়েন ফেলে কোন রঙের বল বের হবে, সেই কৌতূহলের মতো!

এক উপদেষ্টা বলেন, ‘এ অভ্যাস বদলানোর চেষ্টা কেউ আর করে না। অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছে সবাই’। ট্রাম্পের ফোন নম্বর শতাধিক মানুষের কাছে রয়েছে বলেও জানান এই উপদেষ্টা।

কয়েকজন সহকারী জানান, ট্রাম্পের কাছে দুটি আলাদা ফোন আছে। একজন সহকারী বলেন, তিনি ট্রাম্পকে তিনটি ফোন ব্যবহার করতে দেখেছেন। তাদের ধারণা, এর একটি শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য।

যদিও তিনি মাঝে মাঝে নিজের নম্বর বদলেছেন। যেমন- ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী থাকার সময় যেই নম্বর ব্যবহার করতেন, সেটি তার প্রথম মেয়াদে বন্ধ হয়ে যায়।

আরও একজন সহকারী জানান, ট্রাম্পের ফোনে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা যোগ করা হয়েছে। তবে চীনা হ্যাকারদের হামলা যেহেতু সরাসরি টেলিকম কোম্পানির ব্যাক-এন্ড সার্ভারে হয়েছিল, তাই সেসব নিরাপত্তা কতটা কার্যকর, সেটা স্পষ্ট নয়। হোয়াইট হাউস অবশ্য প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি। 

তবে ট্রাম্পের এই ফোন-আসক্তিকে তারা ব্যাখ্যা করেছেন ইতিবাচকভাবে। হোয়াইট হাউসের যোগাযোগ পরিচালক স্টিভেন চিউং বলেন, ‘তিনি সব সময় সবার নাগালের মধ্যে থাকেন। এ কারণে তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও সবার জন্য সহজলভ্য প্রেসিডেন্ট’।

এমআইটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও সাবেক কাউন্টারইন্টেলিজেন্স প্রধান জোয়েল ব্রেনার বলেন, ‘আমরা হ্যাকিং, ছদ্মবেশী কল পাওয়ার এবং প্রস্তুত না থাকার ঝুঁকিতে আছি’। 

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘ট্রাম্প যদি প্রস্তুতি ছাড়াই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে এমন প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন, যা তার দল জানতেও পারে না। এটা ভয়াবহ বিপজ্জনক’।

তবে ট্রাম্প এ বিষয়টিকে ঝুঁকি হিসেবে দেখেন না। বরং মনে করেন, তার মোবাইল ফোনই তাকে বিশ্ববাসীর আরও কাছে নিয়ে যায়। 

এক উপদেষ্টা জানান, ‘আমি একবার তাকে কল করেছিলাম, হঠাৎ তিনি বললেন, ‘বিদেশী কোন এক নেতা কল দিচ্ছে আমাকে, ধরতে হবে’। তিনি জানতেনও না কার ফোন আসছে, শুধু বিদেশী নম্বর দেখে ভাবলেন, এটা হয়তো কোনো নেতা হতে পারে, কথা বলা দরকার’।

২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়েই ট্রাম্পের টিম প্রথম বুঝতে পারে যে, তার মোবাইল ব্যবহারের ধরন অন্য যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে আলাদা। এক উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি সেই রাতে প্রতিটি কল ধরছিলেন। তার ফোনবুকে নাম না থাকা নম্বর থেকে কল এলেও তিনি রিসিভ করে কথা বলছিলেন। তিনি হয়তো কোনো কলই ফিরিয়ে দিতে চান না।

নির্বাচনের আগে ও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র বানানো প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন ট্রাম্প। আর তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে বড় প্রচারযন্ত্র। মোটা লাল টাইয়ের মতোই এটি যেন তার পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের সুইচবোর্ড ব্যবহার করে কল করলেও এখন তা প্রায়ই এড়িয়ে চলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, সরকারি ব্যবস্থার ভেতরে ‘ডিপ স্টেট’ নামে একটি গোপন শক্তি তার বিপক্ষে কাজ করছে, ফোনেও তারা আড়ি পাততে পারে।

এ সন্দেহ অমূলক ছিল না। এর আগে তার রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ফোনালাপের তথ্য ও ট্রান্সক্রিপ্ট গণমাধ্যমে ফাঁস হয়। বিশেষ করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের উদ্বিগ্ন করে।

সাবেক এক উপদেষ্টা বলেন, ‘ওনার (ট্রাম্পের) দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, ‘আমি হোয়াইট হাউসের কাউকে বিশ্বাস করি না, তাই নিজেই মোবাইল ব্যবহার করব।’

উপদেষ্টারা বহুবার চেষ্টা করেছেন তাকে এ অভ্যাস থেকে ফেরাতে। ২০১৭ সালে ট্রাম্পের দ্বিতীয় চিফ অব স্টাফ হন অবসরপ্রাপ্ত মেরিন কর্পস জেনারেল জন কেলি। তার নিরাপত্তা-শৃঙ্খলা ছিল কঠোর। 

একাধিক সাবেক ও বর্তমান উপদেষ্টা জানান, কেলি ট্রাম্পকে বারবার সতর্ক করেছিলেন কীভাবে হ্যাকিং হতে পারে বা ফোন নিজেই হয়ে উঠতে পারে গুপ্তচরযন্ত্র। তাই ওভাল অফিসে ট্রাম্পের ফোন ঢুকলেই সেটা নিয়ে বাইরে একটি সুরক্ষিত বাক্সে রেখে দেওয়া হতো।

তবে ট্রাম্প ছিলেন অটল। তিনি বলে দিতেন, ‘এগুলো মিথ্যা, আমার ফোন বাজারের সেরা’।

তাই দ্বিতীয় মেয়াদে উপদেষ্টারা চেষ্টা করা ছেড়েই দিয়েছেন। তার প্রচার উপদেষ্টা ক্রিস লা সিভিটা বলেন, ‘তিনি তো মানুষকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ফোন করেন। আমরা কিছু বলি না, কারণ বলেই বা কী হবে? তার ফোন কেড়ে নেব? নাম্বার বদলাব? না বলব ফোন করা ছেড়ে দিতে?’

তবে উপদেষ্টারা চুপ থাকলেও ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। বিদেশি গোয়েন্দারা এখনো ট্রাম্পের ব্যক্তিগত কথোপকথনে আড়ি পাততে পারে, তা হোক ওভাল অফিসে, গলফ কোর্সে, কিংবা বাসভবনে। 

২০২৪ সালে চীনের একটি সাইবার হামলায় অন্তত ৯টি টেলিকম কোম্পানি আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ছিল ফোন কল রেকর্ড ও টেক্সট সংগ্রহের মতো গুপ্তচর তৎপরতা। ট্রাম্প, সিনেটর জেডি ভ্যান্স, এমনকি কমলা হ্যারিসের নির্বাচনী প্রচার-দলের সদস্যরাও ওই আক্রমণের লক্ষবস্তু ছিলেন। 

বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা টিম জানায়, ওই হামলার ফলে কোথায় কে আছেন তা শনাক্ত করা, যখন খুশি ফোন কল রেকর্ড করা, এমনকি ১০০টির বেশি ফোনের সব বার্তা সংগ্রহ করা সবই সম্ভব হয়েছে।

‘তোমার প্রিয় প্রেসিডেন্ট বলছি’

ট্রাম্প ভয়েস মেইলে বার্তা পাঠাতেও ভালোবাসেন। ট্রাম্পের এক সাবেক উপদেষ্টা জানান, তিনি প্রায়ই তার পরিচিতজনদের ভয়েসমেইলে বার্তা পাঠাতেন। তিনি চাইতেন, অন্যরা যেন তার ভয়েসমেইল বারবার শুনে তাকে মনে রাখেন কিংবা পরিবারকে শুনিয়ে আনন্দ পান।

২০২৫ সালের মে মাসে কার্টুনিস্ট স্কট অ্যাডামস একটি অজানা নাম্বার থেকে কল পেয়ে সেই নাম্বারে ভয়েসমেইলে পাঠান। পরে ফিরতি ভয়েসমেইল শুনে তিনি হতভম্ব! সেখানে ট্রাম্প নিজে বলছেন, ‘তোমার প্রিয় প্রেসিডেন্ট বলছি’। 

অ্যাডামস পরে বলেন, ‘আমি তো ভাবলাম, এ কী করলাম! পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে ভয়েসমেইল পাঠিয়ে দিলাম!

ট্রাম্প সেখানে একটি দীর্ঘ বার্তা রেখে বলেন, ‘এই নাম্বারে আমাকে কল করো’। যদিও অ্যাডামস ফোন করেননি, কারণ ‘তা করলে অদ্ভুত দেখাত’। অ্যাডামসের শরীরে বাসা বেঁধেছিলো ক্যান্সার, সে খবর অনেকের মাঝে জানাজানিও হয়েছিল।

এর কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন করে ট্রাম্প। এবার অ্যাডামস ধরেন। ট্রাম্প তার শারীরিক অবস্থার কথা শুনে নানা প্রশ্ন করেন, আর শেষে বলেন, কোনো কিছুর দরকার হলে শুধু বলতে, তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।

যখন তখন কল দেওয়া যাবে না 

ট্রাম্পের নাম্বার থাকা সত্ত্বেও অনেকেই তাকে ফোন করতে দ্বিধা করেন। এক উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি ফোন করার আগে অন্যদের থেকে খোঁজ নিই, তিনি কী করছেন। কেউ বলে দেয়, ডিনার সেরে বাসভবনে ঢুকেছেন। এসব জেনেই ফোন করি’।

ট্রাম্পের অন্য এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেন, ‘আমি খুব কম ফোন করি, যদি না উনি বলেন’। কারণ, ট্রাম্প মাঝে মাঝে ফোন হাতে নিয়ে দেখে নেন কে কে ফোন দিয়েছেন, মাঝেমাঝে আবার কলদাতাদের অস্থিরতা নিয়ে মজা করেন’। এ জন্যই ফোন করতে দ্বিধা হয়, উনি যেন না বলেন, ‘দেখো দেখি কে আবার ফোন দিচ্ছে’।

অনেকে আবার কল দেওয়ার সময়ে এতো ভাবেন না। এক সংবাদ সম্মেলনের সময় ট্রাম্পের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। অ্যাপলের ৫০ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলছিলেন, আর তখনই ট্রাম্পের ফোনে বেজে ওঠে অ্যাপলের সেই পরিচিত ‘রিফ্লেকশন’ রিংটোন। 

প্রেস রুমে সাংবাদিকেরা প্রবেশ করার আগেই প্রেসিডেন্ট তার ফোনটি ডেস্কে রেখে দেন, পাশেই ছিল হোয়াইট হাউসের দুটি ল্যান্ডলাইন টেলিফোন। ফোন বেজে উঠতেই তিনি মজা করে বলেন, ‘কল আসছে, কিছু মনে করবেন না’। পরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা দেখি এক কংগ্রেস সদস্য’। কয়েক সেকেন্ড পরে আবার ফোন বেজে ওঠে। ট্রাম্প বলেন, ‘এবার দেখি আরেক কংগ্রেস সদস্য’...। আর নিজের ফোনটি সাইলেন্ট করার চেষ্টায় হিমশিম খেতে খেতে হেসে ওঠেন ট্রাম্প। সূত্র: দ্য আটলান্টিক