
কেউ গাড়িতে, কেউ চলছেন পদব্রজে। দেহ মনে তাদের অপার্থিব রোমাঞ্চ, কণ্ঠে তালবিয়া। গন্তব্য-মিনা। রচিত হয়েছে এক অভাবনীয়; অসামান্য অপার্থিব দৃশ্যপট। পবিত্র মক্কা থেকে মিনার পথমালা লাখে লাখে মানুষের পদভারে মুখরিত। আকাশ বাতাস মন্দ্রিত করছে—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ (আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার কোনো শরিক নেই; আমি হাজির; নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য একমাত্র আপনারই। আপনার কোনো অংশীদার নেই। (বুখারি, হাদিস: ১৫৪৯; মুসলিম, হাদিস :২৮১১)। এই তাবু নগরী মিনা থেকেই সূচনা হচ্ছে পবিত্র হজ। নজিরবিহীন নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবী থেকে আগত লাখ লাখ হজযাত্রী মসজিদুল হারামে (কাবা) গতকাল মঙ্গলবার জোহরের সালাত আদায় করেন। অতঃপর পবিত্র হজ পালন করতে রওনা হন মক্কা থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মিনার উদ্দেশে। সেখানে সারা দিন ও সারা রাত অবস্থানের মধ্য দিয়ে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতার শুরু হবে আল্লাহর মেহমানদের।
দীর্ঘ যানজট এড়াতে অনেকে মিনায় যাচ্ছেন পায়ে হেঁটে। অন্য হাজিদের মতো বাংলাদেশের ৮৭ হাজার ১৫৭ জন হাজিও রওনা হয়েছেন মিনার পথে। ফজরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত মিনার পথে মুমিন মুসলমান বান্দাদের এ কাফেলা চলবে। মিনায় পৌঁছে তারা সেখানে যার যার তাঁবুতে (ফায়ার প্রুফ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) অবস্থান করে আজ বুধবার জোহর থেকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ফজরসহ মোট পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সঙ্গে আদায় করার পাশাপাশি অন্যান্য ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। এদিন রাতে মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য কাল বৃহস্পতিবার ভোরে তারা যাবেন বিদায় হজের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত আরাফাত ময়দানে। সেখানে তারা হজের মূল রোকন ‘ওকুফে আরাফা’ পালন করবেন, যা হজের অন্যতম ফরজ অংশ। সেলাইবিহীন শুভ্র এক কাপড়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবেন। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। সূর্যাস্তের পর আরাফাত থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় গিয়ে রাতযাপন ও পাথর সংগ্রহ করবেন হাজিরা। ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় ফিরবেন। ১০ জিলহজ মিনায় প্রত্যাবর্তনের পর হাজীদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শয়তানকে (জামারা) পাথর নিক্ষেপ, আল্ল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি, (অনেকেই মিনায় না পারলে মক্কায় ফিরে গিয়ে পশু কোরবানি দেন।) মাথা ন্যাড়া করা এবং তাওয়াফে জিয়ারত। মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করবেন ও প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করবেন। সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ি তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
ইসলামের পাঁজ স্তম্ভের অন্যতম পবিত্র হজ। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য সারা জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা ফরজ, অর্থাৎ অবশ্যই পালনীয়। মোয়াল্লেমরা জানান, মিনায় থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিতে হবে। ইহরামের কাপড় (আড়াই হাত বহরের আড়াই গজ কাপড় আর গায়ের চাদরের জন্য একই বহরের তিন গজ কাপড়) এক সেট পরে নিতে হবে, অতিরিক্ত আরেক সেট থাকবে ব্যাগে। এছাড়া এক সেট সাধারণ পোশাক (শার্ট-প্যান্ট অথবা পাঞ্জাবি-পায়জামা) পেস্ট, ব্রাশ, সাবান, চার্জারসহ মুঠোফোন, কোরবানির কুপন মুজদালিফায় রাতে ঘুমানোর জন্য হালকা বিছানাসহ প্রয়োজনীয় জিনিস ছোট ব্যাগে নিলে ভালো হয়। কারণ, নিজের ব্যাগ নিজেকে বহন করতে হবে। মোয়াল্লেম শুধু খাবারের ব্যবস্থা করবেন। একই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে মিনার তাঁবু নম্বর-সংবলিত কার্ড। ঐ কার্ড সবসময় গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হয়। একইভাবে মিনা, মুজদালিফা, আরাফাতে কীভাবে কখন রওনা হবেন, তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয় আগেভাগে। মিনায় হাজিদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় মোয়াল্লেম আছেন।
হজের খুতবা দেবেন শায়খ সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ:
চলতি বছর সৌদির স্থানীয় সময় আগামীকাল ৯ জিলহজ (৫ জুন) আরাফাতের ময়দানে মসজিদে নামিরা থেকে হজে অংশগ্রহণকারী মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশে হজের খুতবা দেবেন মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদের বিশিষ্ট আলেম, সম্মানিত ইমাম ও খতিব শেখ সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ। সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ এ নির্দেশনা দিয়েছেন। মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ ও মদিনার নববি মসজিদ কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে। খুতবার দায়িত্ব পাওয়া শেখ সালেহ বিন হুমাইদ সৌদি আরবের অন্যতম শীর্ষ আলেম হওয়ার পাশাপাশি একাধারে নামকরা ইসলামিক পণ্ডিত এবং কয়েকটি গ্রন্থের লেখক। সৌদি আরবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আবদুল্লাহ হুমাইদ কাজ করেছেন। তিনি সৌদি মজলিশ আল শুরার স্পিকার, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, কাউন্সিল অব ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফিকহ অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্ট, দুটো পবিত্র মসজিদের জেনারেল প্রেসিডেন্সির প্রধান এবং সৌদি রয়াল কোর্টের উপদেষ্টা।
এই প্রথম নিরাপত্তা দেবে ফ্যালকন ড্রোন:
এই বছরের হজ মৌসুমে সৌদি আরবে নিরাপত্তা ও উদ্ধারকাজে প্রযুক্তিগত এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো ‘ফ্যালকন’ নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ফায়ারফাইটিং ড্রোন মোতায়েন করা হচ্ছে, যা উচ্চতা ও দুর্গম স্থানে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত হবে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আরব নিউজ। রোববার সৌদি সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল হামুদ বিন সুলায়মান আল-ফারাজ এই তথ্য নিশ্চিত করেন। সৌদি প্রেস এজেন্সিকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ড্রোনটির প্রযুক্তিগত ক্ষমতা হজের সময় বিশাল জনসমাগমের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এক যুগান্তকারী সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ফ্যালকন ড্রোনের বৈশিষ্ট্য :এর অপারেশনাল সময়-একটানা ১২ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম এই ড্রোন। প্রায় ৪০ কিলোগ্রাম ওজন বহনে সক্ষম। তাপমাত্রা নির্ণায়ক ক্যামেরার মাধ্যমে আগুনের উত্স শনাক্ত করতে পারে। রিয়েল টাইম ভিডিও সরাসরি নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে মনিটরিং করা যায়। এটা ব্যবহার উপযোগী স্থানের মধ্যে আছে বহুতল ভবন, শিল্প এলাকা, বিপজ্জনক রাসায়নিক সংরক্ষিত স্থান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও বনভূমি।