Image description
 
 

কাশ্মীরের পর্যটনঘেঁষা পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ফুঁসে ওঠে ভারত। হামলার দায় অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের দিকেই সরাসরি আঙুল তোলে দেশটি।

প্রতিক্রিয়ায় সীমান্তপারের জঙ্গি ঘাঁটিতে চালানো হয় পাল্টা হামলা— যার নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’। তবে লড়াইটা এখানেই থেমে নেই। আর এর রেশ কাটতে না কাটতেই দেশজুড়ে চোখে পড়ছে আরেক অদৃশ্য যুদ্ধের চিহ্ন।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতায় গত এক মাসে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ও পাঞ্জাবে অন্তত ১৫ জন ভারতীয় নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছেন, যারা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর হয়ে তথ্য পাচারে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।

 

শনিবার (৩১ মে) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

 
 

প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের কারও পেশা সরকারি চাকরি, কেউ প্রযুক্তিবিদ, কেউ ইউটিউবার, কেউ নিরাপত্তাকর্মী কিংবা সিমকার্ড বিক্রেতা— দেখলে কেউ ভাববেই না, এই চেনা মুখগুলো আদতে রাষ্ট্রবিরোধী মিশনে নিযুক্ত ছিল। অথচ ধরা পড়ার পর বেরিয়ে এসেছে এমন সব তথ্য, যা গোটা জাতির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।

 

মোটি রাম জাট : সেনা ইউনিফর্মের আড়ালে বিশ্বাসঘাতকতা

সিআরপিএফ-এর এক নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা হলেও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনসংক্রান্ত তথ্য ছিল মোটি রাম জাটের কাছে। তদন্তে জানা গেছে, ২০২৩ সাল থেকেই তিনি আইএসআইয়ের একাধিক অপারেটিভের সঙ্গে আর্থিক বিনিময়ে তথ্য পাচার করছিলেন। মে মাসে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এনআইএ এখন খতিয়ে দেখছে, ঠিক কোন ধরনের গোপন নথি বা মিশনের তথ্য তিনি ফাঁস করেছেন।

‘হানিট্র্যাপ’-এ ধরা পড়া নৌ-প্রকৌশলী

মুম্বাই নৌঘাঁটির ইঞ্জিনিয়ার রবীন্দ্র ভার্মা পাকিস্তানি নারী অপারেটিভদের সঙ্গে ফেসবুকভিত্তিক ‘হানিট্র্যাপ’-এ জড়িয়ে পড়েন। ‘পায়েল শর্মা’ ও ‘ইসপ্রীত’ নামের দুটি ভুয়া প্রোফাইলের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলার পর তিনি সাবমেরিনের নকশা, যুদ্ধজাহাজের অন্দরমহলের ছবি, শব্দ সংকেত ইত্যাদি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাঠাতে থাকেন। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দাবি, সে জেনে শুনেই এ কাজ করেছে। বর্তমানে সে পুলিশের হেফাজতে।

ভ্রমণব্লগার থেকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জড়ানো : জ্যোতি মালহোত্রা

জনপ্রিয় ভ্লগার জ্যোতি মালহোত্রা ঘুরে বেড়াতেন পাকিস্তানের অলিগলিতে, সঙ্গে থাকত সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী। হরিয়ানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, পাকিস্তানি দূতাবাস ও আইএসআইয়ের তিনজন অপারেটিভের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তার ফোন ও ল্যাপটপ থেকে ১২ টেরাবাইটের বেশি তথ্য উদ্ধার হয়েছে, যাতে ছিল গোপন চ্যাট, নথি ও ভ্রমণের পরিকল্পনা। মামলার তদন্ত এখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদের আওতায়।

সামরিক ছবি পাঠিয়ে টাকা নেওয়া স্বাস্থ্যকর্মী

গুজরাটের কচ্ছ জেলার স্বাস্থ্যকর্মী সাহদেব সিং গোহিল ভারতীয় সেনা ও বিএসএফ-এর ঘাঁটির ছবি ও ভিডিও পাকিস্তানে পাঠাতেন। হোয়াটসঅ্যাপে ‘আদিতি ভরদ্বাজ’ নামে এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে তিনি এই কাজ করতেন বলে অভিযোগ। ধারণা করা হচ্ছে, ওই নারী ছিলেন আইএসআইয়ের একজন 'ডিপ্লয়েড অ্যাসেট'। সাহদেব এর বিনিময়ে পেয়েছেন ৪০ হাজার রুপি।

চাকরির আশায় চরবৃত্তিতে : হরিয়ানার চার যুবক

দবেন্দর সিং (পাঠিয়ালা), নওমান ইলাহী (পানিপত), আরমান ও তারিফ (নুহ)— এ চার তরুণ অর্থের বিনিময়ে সেনাঘাঁটি, অস্ত্রের ছবি, অবস্থান ইত্যাদি তথ্য হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতেন। তারিফকে গ্রেপ্তারের সময় মোবাইল থেকে পাকিস্তানি নম্বরের সঙ্গে চলমান হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট মুছে ফেলার চেষ্টা করতে দেখা যায়। পুলিশ বলছে, অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এদের টার্গেট করেছিল আইএসআই।

রাজস্থানের সরকারি কর্মকর্তা : বিদেশ সফরের রহস্য

শাকুর খান, জয়সলমের জেলার এক সরকারি কর্মচারী, যিনি সাতবার পাকিস্তান সফর করেছেন, কিন্তু তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি ছিলেন রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী শালে মোহাম্মদের ব্যক্তিগত সহকারী। তার ডিভাইস থেকে পাওয়া গেছে মুছে ফেলা মেইল ও অর্থ লেনদেনের রেকর্ড। এখন এনআইএ ও র’ তার নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ করছে।

টেক-সচেতন চর : মোবাইল অ্যাপ বানিয়ে পাচার

পাঞ্জাবের প্রযুক্তিবিদ মোহাম্মদ মুর্তাজা আলী নিজেই একটি মোবাইল অ্যাপ বানিয়ে তথ্য পাচারের মাধ্যম হিসেবে সেটি ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ। উত্তরপ্রদেশের ব্যবসায়ী শাহজাদও সামরিক ঘাঁটির ভিডিও ও নথি পাঠাতেন পাকিস্তানি অপারেটিভদের কাছে।

সিমকার্ড পাচার ও ডিজিটাল চ্যানেল ব্যবহারের কৌশল

দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার রাজস্থানের কাসিম ভারতীয় মোবাইল সিমকার্ড জোগাড় করে সেগুলো পাকিস্তানি অপারেটিভদের সরবরাহ করতেন। থানের এক যুবক হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে তথ্য পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে একাধিক মোবাইল, জাল কাগজপত্র ও টাকার লেনদেনের প্রমাণ।

অভিযানের পর নজরদারির চেহারা পাল্টে গেছে

পেহেলগাঁও হামলার পর চালানো অপারেশন সিন্দুর ভারতীয় সামরিক ও কূটনৈতিক মহলে চরম প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এরপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিকেও নজর দেয়।

শুধু জয়সলমের জেলাতেই গত এক মাসে সন্দেহভাজন হিসেবে সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের সাইবার ইউনিট ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’-এর যৌথ অভিযানে ধরা পড়েছে গুপ্তচরবৃত্তির এই নেটওয়ার্ক।

তদন্তকারীরা বলছেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দারা এখন আর শুধু সামরিক ঘাঁটির আশপাশে নয়— সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অর্থনৈতিক দুর্বলতা, একাকীত্ব বা সরকারি চাকরির দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো বিষয়কেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

ফলে ‘দেশদ্রোহী’রা এখন কেবল সীমান্ত পেরিয়ে আসা মুখ নয়, বরং অনেক সময় তারা আমাদের মধ্যেই থাকে— একেবারে চেনা চেহারার অচেনা মিশনে।