Image description

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনের সংঘর্ষ শেষ হয়েছে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে। দুই দেশই দাবি করেছে, তারাই জয়ী হয়েছে। কিন্তু দুই পক্ষের এই সংঘর্ষে আলোচনার বাইরে থেকে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প খাতেরও বড় জয় হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

গত মাসে পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়, যাদের বেশিরভাগই পর্যটক। দিল্লি ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে’ সমর্থন করার অভিযোগ এনেছে, যদিও পাকিস্তান সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।

বাগ্‌বিতণ্ডার মধ্যে পাকিস্তানে হামলা শুরু করে ভারত। তারা এ অভিযানের নামকরণ করে ‘অপারেশন সিঁদুর’। এরপর উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা-পাল্টা হামলা চালায়। সংঘর্ষে ব্যবহার করা হয় ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান। ফ্রান্স ও রাশিয়ার তৈরি জেট ভারত ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান বেইজিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি তাদের জে-১০ ও জে-১৭ বিমান ব্যবহার করে।

ভারত ও পাকিস্তান দুপক্ষই জানিয়েছে, তাদের বিমান সীমান্ত অতিক্রম করেনি এবং দূর থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এরই মাঝে ইসলামাবাদ দাবি করে, তারা কমপক্ষে ছয়টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে ফ্রান্স-নির্মিত রাফালে যুদ্ধবিমানও রয়েছে। পাকিস্তানের এই দাবির বিষয়ে ভারত কোনো জবাব দেয়নি।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ার মার্শাল এ কে ভারতী গত সপ্তাহে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ক্ষয়ক্ষতি কমব্যাটের (সংঘর্ষের) একটা অংশ।

মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় যুদ্ধবিমানের মোকাবিলা করতে পাকিস্তান এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল (আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র) ছুড়তে সম্ভবত চীনের তৈরি জে-১০ বিমান ব্যবহার করেছে।

সাম্প্রতিক এই সংঘর্ষে চীনা অস্ত্র ব্যবস্থার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে পাকিস্তানের এই ‘জয়ের’ দাবিকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বেইজিংয়ের প্রতিরক্ষা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি বলে মনে করছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার এ দাবির সঙ্গে একমত নন। কিছু বিশেষজ্ঞ আবার একে চীনা অস্ত্রশিল্পের জন্য ‘ডিপসিক মোমেন্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।

চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্নেল ঝাও বো বিবিসিকে বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক আকাশযুদ্ধ চীনা অস্ত্রশিল্পের জন্য এক বড়সড় বিজ্ঞাপন ছিল। এতদিন চীনের কাছে সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে তাদের তৈরি প্ল্যাটফর্ম কেমন কাজ করে— সেটা পরীক্ষা করে দেখার কোনো সুযোগ ছিল না।

বেইজিংভিত্তিক এই বিশ্লেষক জানিয়েছেন, দুই পক্ষের মধ্যে আকাশের লড়াই দেখিয়ে দিয়েছে যে, চীনের এমন কিছু ব্যবস্থা আছে, যেমনটা অন্য কারো নেই। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পর জে-১০-এর মতো যুদ্ধবিমান প্রস্তুতকারী চীনের অ্যাভিক চেংদু এয়ারক্রাফট কোম্পানির শেয়ারের দাম গত সপ্তাহে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

তবে অন্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন, চীনের অস্ত্রশিল্পের জন্য ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ ঘোষণা করার সময় এখনো আসেনি। লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগের মতে, চীনা যুদ্ধবিমান সত্যিই ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান, বিশেষত রাফালকে টেক্কা দিতে পেরেছে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আদর্শ সামরিক কৌশল বিবেচনা করলে আগে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে হবে এবং স্থলের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার আগেই আকাশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু এখানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পাল্টা হামলার জন্য উসকে দেওয়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর লক্ষ্য ছিল না বলেই মনে হয়েছে।

এদিকে, বেইজিংও কিন্তু জে-১০ ব্যবহার করে রাফাল-সহ ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবর নিয়েও কোনো মন্তব্য করেনি। তবে অসমর্থিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জে-১০ ব্যবহার করে একটা পশ্চিমা অস্ত্র শক্তি (রাফালকে ইঙ্গিত করে) ভূপাতিত করা নিয়ে চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক উল্লাস শুরু হয়েছে।

ভেরোনার ইন্টারন্যাশনাল টিম ফর দ্য স্টাডি অব সিকিউরিটির চীনবিষয়ক গবেষক কার্লোটা রিনাউডো জানিয়েছেন, চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জাতীয়তাবাদী বার্তায় ভরে গেছে। যদিও যেটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা কঠিন। এ মুহূর্তে বাস্তবতার তুলনায় মানুষের ধারণা বা মনোভাবের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি বিষয়টিকে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি, তাহলে এখানে আসলে বিজয়ী হচ্ছে চীন।

চীনের কাছে পাকিস্তান কৌশলগত ও অর্থনৈতিক মিত্র। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ৫০ বিলিয়ন (পাঁচ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন। তাই পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়লে তা চীনের স্বার্থের জন্য ভালো নয়।

পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইমতিয়াজ গুল বলেন, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে চীন একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। এটা ভারতের নীতিনির্ধারকদের বিস্মিত করেছে। আধুনিক যুদ্ধ ইস্যুতে পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে সহযোগিতা যে কতটা গভীর, সেটি তারা সম্ভবত কল্পনাও করেনি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে চীনা জেটের সক্ষমতা পশ্চিমা দেশগুলোতে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে; কারণ এটা বিশ্বব্যাপী অস্ত্রবাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ এবং এ তালিকায় চীন চতুর্থ।

মূলত মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে অস্ত্র বিক্রি করে চীন। এর আগে চীনা অস্ত্র তাদের নিম্নমান ও প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য সমালোচিত হয়েছিল।

আরেকটি বিষয় হল, পাকিস্তানের কাছে ভারতের বিমান ‘খোয়ানোর’ ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালে পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান হামলার পর উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সংক্ষিপ্ত আকাশযুদ্ধের সময় রাশিয়ার তৈরি একটি মিগ-২১ জেটকে পাকিস্তান ভূখণ্ডের ভেতরে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছিল এবং পাইলটকে আটক করা হয়েছিল। অবশ্য কদিন পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর সত্ত্বেও ল্যাডউইগের মতো বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বেশ কিছু লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এ তথ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুব একটা আসেনি। ভারত বেশ সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুলভাবে পাকিস্তানের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে বলেই মনে হয়েছে।

পাকিস্তান বলেছে, ভারতের হামলার জবাবে তারা বেশ কয়েকটি ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হস্তক্ষেপ করে এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য উভয় দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের জন্য পুরো ঘটনাটি একটি সতর্ক বার্তার মতো। এর কারণ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ নিয়ে বেইজিং বিস্তারিত কোনো মন্তব্য না করলেও চীন এটা দেখাতে আগ্রহী যে, তাদের অস্ত্র পশ্চিমাদের তৈরি অস্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে।

এদিকে, দিল্লি ভালোভাবেই জানে পাকিস্তানকে যে যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে চীন, সেগুলো পুরোনো মডেলের। বেইজিং ইতোমধ্যেই আরো উন্নত জে-২০ স্টিলথ ফাইটার জেট অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা রাডারকে ফাঁকি দিতে পারে।

ভারত ও চীনের মধ্যে হিমালয় অঞ্চলে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে এবং ১৯৬২ সালে একটি সংক্ষিপ্ত সীমান্ত যুদ্ধ হয়েছিল, যেখানে ভারতের পরাজয় হয়। ২০২০ সালের জুন মাসেও লাদাখে দুই দেশের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ দেখা গিয়েছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত কিন্তু বেশ ভালোভাবেই সচেতন যে, তাদের দেশি প্রতিরক্ষা শিল্পে বিনিয়োগ দ্রুত শুরু করা দরকার। একইসঙ্গে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রয়ের গতিও বাড়ানো দরকার। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে চীনের বিমানের সাফল্য নিয়ে দাবি ওঠার পর চীনা প্রতিরক্ষা শিল্প আপাতত লাইমলাইটে চলে এসেছে।