Image description

দিনটি ছিল ২৫ মার্চ।  সুন্দর একটি সকাল। চারপাশটা শান্ত-নীরব। মাথার ওপর ছিল না কোনো ড্রোন-যুদ্ধবিমান। চলমান যুদ্ধাতঙ্কের মাঝে একটু অস্থায়ী আনন্দ খুঁজতে বাইরে খেলতে বেরিয়েছিল শিশুরা। তাদের মধ্যে একজন ছিল মোহাম্মদ হাজিজিও (৭)। মুহূর্তেই তার সেই উচ্ছ্বাস রূপ নেয় ট্র্যাজিডিতে। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে আশপাশ। দৌড়ে ছুটে যান মোহাম্মদের বাবা খালেদ হিজাজি। অন্যান্য আহত খেলার সাথীদের সঙ্গে দেখতে পান মোহাম্মদের রক্তাক্ত দেহ। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে। চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন তার চোখ দুটো বাঁচানোর, কিন্তু লাভ হয়নি! শেষমেশ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে মোহাম্মদ। 

ইসরাইলের এ নৃশংসতার শিকার মোহাম্মদসহ এমন আরও অনেকেই। বরাবরের মতো এবারও শিশুদের টার্গেট করছে ইসরাইল। পায়ে-চোখে হামলা চালিয়ে গাজায় পরিকল্পিতভাবে অন্ধ-পঙ্গু প্রজন্ম তৈরি করছে ইসরাইলি সেনারা। শুধু গাজায় নয়, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরেও এই ‘পৈশাচিক পরিকল্পনা’ অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। রয়টার্স, এপি। 

ভয়াবহ সেই দিনের কথা স্মরণ করে কাতরকণ্ঠে মোহাম্মদের বাবা খালেদ হিজাজি বলেন, এটি ঠিক অন্য যেকোনো দিনের মতোই সেই দিনটিও। সে বাইরে খেলছিল; কিন্তু হয়তো সে জানত না তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। বিস্ফোরণের শব্দ এখনো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমরা তাকে সেখানে পড়ে থাকতে দেখেছি, রক্তে ঢাকা প্রাণহীন চোখ-মুখ!

এরপর উত্তর গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মোহাম্মদকে। ডান চোখটি অপারেশন করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাম চোখটির অপারেশনের জন্য বিদেশে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। বাবা আরও বলেন, সে প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করে, আমি আবার কখন দেখতে পাব? কিন্তু আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।

এরপর আর্তনাদ করে মোহাম্মদের বাবা আবেদন জানান, গাজার শিশুদের বাঁচাও। তারা নির্দোষ। আমার একমাত্র ইচ্ছা আমার ছেলে শান্তিতে বাস করুক এবং দেখতে পাক।

একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে গাজার আরও দুই বোনের সঙ্গে। ফিলিস্তিনি কিশোরী মাইসা আল-ঘান্দুরের  বড় স্বপ্ন ছিল ডাক্তার বা শিক্ষিকা হওয়ার। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ইসরাইলি হামলায় অন্ধ হয়ে যায় সে। ১৪ বছর বয়সি মাইসা বলেন, ‘এখন, আমি মরতে চাই। আমরা গাজায় আর জীবিত নই। আমরা কেবল মরার আশায় আছি। এখানে আমাদের জীবন মৃত্যুতে পরিণত হয়েছে।’ তার ৯ বছর বয়সি বোন ইয়ারাও খেলতে বেরিয়েছিল। হঠাৎ ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে উঠোনে। পরপর দুটো। সে বলে, ‘আমাদের বুক, পেট এবং মুখ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে’। মেয়েদের মা, ওলা আল-ঘান্দুর বলেন, ‘আমি আশা করি মাইসা তার সৌন্দর্য ফিরে পাবে। ইয়ারা তার দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছে। তারা উভয়ই সম্পূর্ণ বিকৃত এবং তাদের সৌন্দর্য হারিয়েছে।’  

ইসরাইলের হামলায় চোখ হারিয়েছে এমন আরেক ভাগ্যহত শিশু মোহাম্মদ আবু মোয়াম্মার। হাসপাতালের বিছানায় অন্ধ-পক্ষাঘাতগ্রস্ত মোয়াম্মার একসময় স্বপ্ন দেখত পুলিশ হবে। চিকিৎসা শেষে তাঁবুতে ফিরে সারাক্ষণই ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আমি আবার দেখতে চাই।’ 

এখানেই শেষ নয়, গাজায় এমন দুর্ভাগা আরও অনেকে রয়েছে। তাদেরই একজন মোস্তফা কাদৌরা। ২০২৪ সালের ২৩ আগস্ট তার বয়স যখন মাত্র এক সপ্তাহ, ইসরাইলি হামলায় ডান চোখে আঘাত পায় সে। বহু চেষ্টার পরও সেই চোখ আর ঠিক হয়নি। মোস্তফার দাদি আমনা আবদ রাবু বলেন, ‘আমি জানি না যখন সে বড় হবে তাকে আমরা কী জবাব দেব।’ ইসরাইলি হামলায় চোখ হারানো আরও এক ভুক্তভুগী মালাক। তারা যেই শিবিরটিতে আশ্রয় নিয়েছিল তা যুদ্ধস্থলের কাছে ছিল। একদিন ইমরাইলের হামলায় একটি চোখ হারায় সে। 

৭ অক্টোবর ২০২৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মালাক বলে, ‘আমি প্রচণ্ড ব্যথায় ভুগছি। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। যথেষ্ট হয়েছে! আর পারছি না’। দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধে গাজার ‘অন্ধ প্রজন্ম’কে সাবলম্বী করতে ২০১৬ সালে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করে জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক ত্রাণ ও কর্ম সংস্থান (ইউএনআরডব্লিউএ)।  

ভিশন প্রকল্পটি গাজা শহরের আল-নূর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কেন্দ্রে বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেখানে ‘ভয়েস ড্রিম রিডার অ্যাপ’র সাহায্যে দৃষ্টিহীনদের শেখানো হতো। প্রথম ব্যাচেই দুশ’রও বেশি অন্ধ শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রকল্পটি। প্রত্যেকেরই বয়স ছিল ১৩ বছরের নিচে।  

২০১৪ সালের টানা ৫০ দিনের হামলায় দৃষ্টি হারানো শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়তেই ওই উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। আরব নিউজ। প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর গাজায় নতুন হামলা শুরু হওয়ার পর ঠিক কতজন শিশু এবার অন্ধ হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি।