
মিয়ানমার থেকে অবাধে আসা ইয়াবার বড় চালান নিয়ন্ত্রহীন হয়ে পড়ছে। গড়ে প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে ৫০ লাখেরও বেশি ইয়াবা মিয়ানমারের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। যার বাজারমূল্য বাংলাদেশী টাকায় ৬০ কোটি টাকা। এসব ইয়াবা ট্যাবলেট স্থলপথ ও জলপথ দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। স্থানীয় ও গোয়েন্দাদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব ইয়াবা কারবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দখল করে নেয়া সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশে ইয়াবা বিক্রি করে সেই টাকায় অস্ত্রের মজুদ বাড়াচ্ছে। এসব ভারী অস্ত্র মিয়ানমারে প্রবেশ করছে চীন ও ভারতের সীমান্ত দিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছে, সশস্ত্রবিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির আয়ের কোনো পথ নেই। তাদের নিজ দেশে গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যেতে যুদ্ধবিধ্বংসী আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা মজুদ রেখে মাদক বিক্রি করে আসছে তারা। আমাদের সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ না করা হলে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলও এক সময় তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বলছে, সীমান্ত এলাকা কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও স্থানীয় কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশী মাদক কারবারিদের কাছে অন্তত ৫০ লাখেরও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট প্রবেশ করছে। বিশেষ করে বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে স্থলপথ ও জলপথ দিয়ে ঢুকছে এসব ইয়াবা। ইয়াবার টাকা আরাকান আর্মি ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে। সেখান থেকে ডলার ও মিয়ানমারের মুদ্রায় হুন্ডির মাধ্যমেই যাচ্ছে আরাকান আর্মির কাছে। ওই সূত্র আরো জানায়, আরাকান আর্মি সেই টাকায় অস্ত্র ক্রয় করে নিজেদের আরো শক্তি বৃদ্ধি করছে।
গোয়েন্দাদের ওই সূত্র আরো জানায়, মিয়ানমারের চীনের সীমান্ত এলাকা ওয়াফেনী ও এংন নামক জায়গায় ইয়াবা তৈরির ১৫টি কারখানা রয়েছে। ওই কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। গত বছরও সেখানে এক কাট অর্থাৎ ১০ হাজার পিস ইয়াবা পাইকারি মূল্য আনুমানিক ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। বর্তমানে সেখানকার বড় বড় ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে প্রতি কাট ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে আরাকান আর্মি। বর্তমানে ১০ হাজার পিস ইয়াবা ১২ থেকে ১৩ লাখ লাখ টাকায় আরাকান আর্মির সদস্যরাই বাংলাদেশী মাদক কারবারিদের কাছে সীমান্তে অতিক্রম করে জিরো পয়েন্টে পৌঁছে দিচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে বলেন, বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদমসহ মিয়ানমারের সীমান্তের অন্তত ১০০টি পয়েন্টে স্থলপথ দিয়ে বড়-মাঝারি ইয়াবার চালান ঢুকছে। কক্সবাজারের টেকনাফ, ফিসারিঘাট, মুরুসকুল, মহেশখালী, আনোয়ারা, গহিরা, পতেঙ্গাসহ আরো কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে সবচেয়ে ইয়াবার বড় চালানগুলো যাচ্ছে জলপথে। ইয়াবার বড় চালানগুলো বরিশাল, চাঁদপুর ও খুলনার মোংলা সাগরপথ দিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
এ ব্যাপারে হোয়াক্ষ্যং ইউপি সদস্য জালাল আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সীমান্ত এলাকায় অবাধে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ইয়াবাই নয়, আরাকান আর্মিদের খাবারসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্য বাংলাদেশ থেকে তারা নিচ্ছে। জিরোপয়েন্টগুলোতে আরাকান আর্মির সদস্যরা অবাধে যাতায়াত করছে। ফলে এলাকাবাসী চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সশস্ত্র আরাকান আর্মি এখন মাদকের ওপর নির্ভরশীল। তাদের অস্ত্রের অর্থ জোগানও ইয়াবা বিক্রির টাকায়। তারা এমনিই অস্ত্রের দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী যদি কঠোর না হয় তাহলে ওই অঞ্চল আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগাররা যখন গৃহযুদ্ধে জড়ায়। তখন কিন্তু তারা মাদকের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। তাদের অস্ত্র কেনাকাটা এবং অর্থ উপার্জনের পথ ছিল মাদক বিক্রি। একইভাবে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের আরাকান আর্মিরাও একই পথে এগোচ্ছে। আমাদের সীমান্তে আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সশস্ত্র আরাকান আর্মির সদস্যরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্যঞ্চলগুলোতে বিচরণ করছে। স্থানীয় চাকমাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তাদের। এমন পরিস্থিতিতে পার্বত্যঞ্চলে বসবাসকারীরা চরম নিরাপাত্তাহীনতায় ভুগছেন। সীমান্তে আরো নিরাপত্তা বৃদ্ধি না করা হলে পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে।
সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কর্নেল শরিফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, মিয়ানমার সিমান্তে বিজিবির সদস্যরা সবসময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা মাদক নিয়মিত আটক করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কাজ করছে বিজিবি। একাধিক সূত্র জানায়, জলপথে টহলের দায়িত্ব কোস্টগার্ডের। দেশের সবচেয়ে মাদকের বড় চালান যে কয়টি আটক করা হয়েছে সেগুলো জলপথের। স্থানীয় সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সদস্যরা ভারতেও ইয়াবা পাচার করছে। বিনিময়ে সেখান থেকে অবৈধ অস্ত্র মজুদ করছে।