
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা এবং তা ঘিরে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্ট সম্ভাব্যতা আবারও বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। পাল্টাপাল্টি হামলা ও হুঁশিয়ারির মধ্যেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যদিও প্রকাশ্যে নানা অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ শোনা গেছে, তবে জনমনে এখন বড় প্রশ্ন— কি এমন গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হঠাৎ করে 'রণে ভঙ্গ' দিল দুই দেশ? বিশেষ করে ভারত?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে দুই দেশের পারমাণবিক কৌশল ও নীতির দিকে, কারণ অনেক বিশ্লেষকের মতে, সম্ভাব্য পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি ছিল এই সঙ্কটের পেছনে অন্যতম চালিকা শক্তি।
পারমাণবিক প্রতিযোগিতার শুরু: ১৯৯৮-এর পরীক্ষা
১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পরমাণু শক্তিধর দেশের তালিকায় নাম লেখায়। এই ঘোষণার পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামো হয়ে ওঠে এক জটিল, অনিশ্চিত ও দোদুল্যমান সমীকরণ। কারণ পারমাণবিক অস্ত্র এ অঞ্চলে আর শুধু কাগুজে নীতিগত অবস্থান নয়, বরং অস্তিত্বের প্রশ্নে রূপ নিয়েছে।
ভারতের নীতি: নো ফার্স্ট ইউজ— কিন্তু কতটা দৃঢ়?
ভারতের পরমাণু নীতির ভিত্তি হলো No First Use (NFU) বা প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করা। ২০০৩ সালে এই নীতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে ভারত। এই নীতির আওতায় ভারত প্রতিজ্ঞা করে যে, সে কখনোই আগে পারমাণবিক হামলা করবে না— তবে যদি তার ওপর পারমাণবিক হামলা হয়, তবে ব্যাপক পাল্টা আঘাত হানবে।
তবে এই নীতির অটলতা নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ইঙ্গিত দেন যে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি এই নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। এই মন্তব্যে স্পষ্ট হয়, ভারতের কৌশলগত নীতিতে নমনীয়তার সম্ভাবনা রয়েছে— যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
পাকিস্তানের কৌশল: ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা ও ট্যাকটিক্যাল পরমাণু অস্ত্র
পাকিস্তান কখনোই কোনো আনুষ্ঠানিক NFU নীতি ঘোষণা করেনি। বরং তাদের পারমাণবিক কৌশল ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাম্বিগুইটি’ বা কৌশলগত অস্পষ্টতার উপর নির্ভর করে।
২০০১ সালে পাকিস্তানি পারমাণবিক উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) খালিদ কিদুয়াই চারটি ‘রেডলাইন’ উল্লেখ করেন যেগুলোর যেকোনো একটি লঙ্ঘন হলেই পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে:
- গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হারানো
- সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি
- অর্থনৈতিক অবরুদ্ধতা
- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
তবে এসব ট্রিগারের মাত্রা কী হবে, তা আজও অস্পষ্ট রাখা হয়েছে— এবং এটিই পাকিস্তানের কৌশলগত প্রতিরোধের মূল ভিত্তি।
২০২৪ সালের মে মাসে খালিদ কিদুয়াই আবারও ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের কোনো NFU নীতি নেই। একইসঙ্গে পাকিস্তান ২০১১ সাল থেকে ছোট পরিসরের ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়েপন (TNW) বা যুদ্ধক্ষেত্রের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন করেছে, যা সীমান্তের কাছাকাছি ভারতীয় সেনা উপস্থিতির বিরুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী।
পারমাণবিক যুদ্ধের প্রান্তে কি এসেছিল উপমহাদেশ?
সাম্প্রতিক সংঘাতে ভারতের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা সংযম ও হঠাৎ যুদ্ধবিরতি অনেককেই ভাবিয়েছে— পাকিস্তান কি তবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিল? অথবা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা উপাত্তে কি এমন কিছু ছিল যা ভারতকে সতর্ক করেছিল যে সংঘাত গড়ালে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের ট্যাকটিক্যাল অস্ত্রের উপস্থিতি এবং পারমাণবিক ‘প্রথম ব্যবহার’ নীতির অভাব ভারতকে কৌশলগতভাবে পিছিয়ে দেয়। কারণ, ভারত জানে না কখন পাকিস্তান তার রেডলাইন অতিক্রমিত হয়েছে বলে ধরে নিয়ে পারমাণবিক আঘাত হানবে।
একটি বোতাম, একটি ভুল, একটি ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যৎ
ভারতের প্রতিরোধমূলক পারমাণবিক নীতির বিপরীতে পাকিস্তানের তীব্র ও অস্পষ্ট অবস্থান একটি ভয়ানক নিরাপত্তা দ্বিধার জন্ম দিয়েছে। যদি ভারত এনএফইউ নীতি থেকে সরেও আসে, তাহলে সেই দোদুল্যমানতা আরও বিপজ্জনক রূপ নেবে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের স্বল্পপাল্লার পারমাণবিক অস্ত্র যে কোনো প্রচলিত যুদ্ধকে মুহূর্তেই পরমাণু যুদ্ধে রূপ দিতে পারে।
এমন এক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে একটি ভুল বোতাম চাপলেই— শেষ হতে পারে উপমহাদেশের অস্তিত্ব, ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে লাখো বছরের সভ্যতা।দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক যুদ্ধ কখনো কেবল অস্ত্রের ভারসাম্য নয়, বরং কৌশলগত ধৈর্য, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং আস্থার প্রশ্ন। আর এই বিশ্বাস ও ধৈর্য টিকিয়ে রাখাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ— কারণ এখানে কোনো ভুল সংশোধনের সুযোগ নেই, আর যুদ্ধ শুরু হলে থামানোর আর সময়ও থাকবে না।