Image description

তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল মুক্তির দিন। তার ভাষায়, ‘রাষ্ট্রপতি হওয়া সেই মুক্তির কাছে নগণ্য ঘটনা।'

এই জীবনাচরণ তাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রপ্রধান’ উপাধি এনে দেয়। তবে মুজিকা বরাবর এই নাম প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গরিব না। গরিব তারা, যারা আরো চায়, যারা চাহিদার দৌড়ে কেবল দৌড়ায়।‘

উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা আর নেই। সরল জীবন, বিপ্লবী অতীত আর সমাজ সংস্কারে তার ভূমিকা বিশ্বজুড়ে পেয়েছিল বিস্তৃত সম্মান। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৯ বছর। মৃত্যুর কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো না হলেও জানা গেছে, মুজিকা দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যনালীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন। খবর বিবিসি।

‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রপ্রধান’ নামে পরিচিত এই নেতা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সরকারি জীবনে তার অতুলনীয় সরলতা, ভোগবাদবিরোধী বক্তব্য এবং সমাজ সংস্কারমূলক নানা উদ্যোগ তাকে শুধু লাতিন আমেরিকায় নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত করে তোলে।

উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু অর্সি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ মুজিকার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে লেখেন, ‘আপনি যা কিছু আমাদের জন্য রেখে গেছেন, আর জনগণের প্রতি আপনার ভালোবাসার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ।‘

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মুজিকার বেড়ে ওঠা মন্টেভিডিও শহরে। মা থেকে তিনি রাজনীতি, বই পড়া ও কৃষিকাজের প্রতি আগ্রহ পেয়েছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি ডানপন্থী ন্যাশনাল পার্টির সদস্য ছিলেন। পরে ষাটের দশকে তিনি হয়ে ওঠেন বামপন্থী শহুরে গেরিলা সংগঠন টুপামারোসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

মুজিকা মোট চারবার বন্দি হন, একবার গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছেছিলেন। তিনি দুটি বড় কারাগার পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস গড়েছিলেন। একবার ১০৫ জন বন্দির সঙ্গে একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পালিয়ে যান।

কারাবন্দি জীবনে তিনি ১৪ বছরেরও বেশি সময় কাটান—প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার হন, দীর্ঘ সময় ধরে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছিলেন। তার ভাষায়, ‘পাগলামি কী জিনিস আমি সশরীরে অনুভব করেছি। পোকামাকড়ের সঙ্গে কথা বলতাম।‘

তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল মুক্তির দিন। তার ভাষায়, ‘রাষ্ট্রপতি হওয়া সেই মুক্তির কাছে নগণ্য ঘটনা।'

mujica

মার্ক্সিস্ট গেরিলা থেকে এক সময় চাষাবাদও করেছেন মুজিকা। ছবি- এপি

গেরিলা জীবন শেষে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হন, পরে কৃষিমন্ত্রী। ২০১০ সালে ৭৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুজিকা। এই সময়টিতে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই ক্ষমতায় আসেন তিনি। তবে তার শাসন ছিল স্বতন্ত্র—প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার মিশেলে গড়া। ৫ দশমিক ৪% বার্ষিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনীতিকে গড়ে তুলেছিলেন। দারিদ্র্য হ্রাস পায়, বেকারত্বও থাকে নিম্নস্তরে।

তার শাসনামলেই উরুগুয়ে সংসদ পাশ করে বিতর্কিত কিন্তু প্রগতিশীল আইন—গর্ভপাত বৈধতা, সমকামী বিয়ের স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে গাঁজা নিয়ন্ত্রণের আইন।

রাষ্ট্রপতির জন্য নির্ধারিত প্রাসাদে না থেকে স্ত্রী লুসিয়া তোপোলানস্কির সঙ্গে শহরের উপকণ্ঠে নিজ বাড়িতেই থাকতেন মুজিকা। গাড়ি ছিল ১৯৮৭ সালের একটি হালকা নীল ভক্সওয়াগেন বিটল। তিনি অধিকাংশ বেতন দান করতেন দরিদ্রদের সহায়তায়।

এই জীবনাচরণ তাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রপ্রধান’ উপাধি এনে দেয়। তবে মুজিকা বরাবর এই নাম প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গরিব না। গরিব তারা, যারা আরো চায়, যারা চাহিদার দৌড়ে কেবল দৌড়ায়।‘

তার সরকার সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে। শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়াও ছিল একটি বড় ব্যর্থতা। তবে, দুর্নীতি বা গণতন্ত্র ধ্বংসের অভিযোগ কখনোই তার বিরুদ্ধে ওঠেনি।

ক্ষমতা ছাড়ার পরও তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে থেকে গিয়েছিলেন। ২০২০ সালে রাজনীতি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন। তার উত্তরসূরি ইয়ামান্দু অর্সি ২০২৪ সালে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

গত বছর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর মুজিকা মৃত্যুর প্রসঙ্গ নিয়েও মুখ খুলেছিলেন। তার শেষ সাক্ষাৎকারে মুজিকা বলেন, ‘মৃত্যু যে অনিবার্য, সেটা আমরা জানি। আর সম্ভবত সেটাই জীবনের স্বাদ, জীবনকে পূর্ণতা এনে দেয়া তিক্ততা।‘