
যুদ্ধ উন্মাদনায় ভাসছে ভারতের গণমাধ্যম। পাক-ভারত সংঘাতের প্রকৃত তথ্য তো দূরে থাক ভুয়া তথ্য ছড়ানো, ভারতের ক্ষতির তথ্য অস্বীকার করা- এমনকি গাজা যুদ্ধের ছবিকে পাকিস্তানে হামলার ছবি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম এ মিথ্যাচার। টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে, আজতাক, এনডিটিভির মতো মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো এই দলের বাইরে নয়।
ইন্ডিয়া টুডের একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘ইন্ডিয়া হিটস করাচি ফার্স্ট টাইম সিন্স নাইনটি সেভেনটি ওয়ান’। করাচি বন্দরে হামলার কোনো খবর পাকিস্তান বা বিশ্বের আর কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়নি। আজতক টিভির এক খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির গ্রেপ্তার হয়েছেন। টাইমস নাউ ও রিপাবলিক টিভির এক খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। জি নিউজের এক খবরে বলা হয়, ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। রিপাবলিক টিভির আরেকটি শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বড় ধরনের বিস্ফোরণ’।
এসব সংবাদের অধিকাংশই যে ভুয়া তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এসব ভুয়া খবর ছড়ানোর কারণে ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা তো হারিয়েছেই পাশাপাশি পরিণত হয়েছে হাসির পাত্রে।
ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রতিযোগিতার মধ্যে যেসব মিডিয়া কিছুটা সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে সেগুলোর ওয়েবসাইট ব্লক করছে বিজেপি সরকার। ইতিমধ্যে বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ারের সাইট ব্লক করেছে কর্তৃপক্ষ। সংবাদমাধ্যমটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ভারতের সংবিধানে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা লঙ্ঘন করে দেশ জুড়ে ওয়ারের একসেস বন্ধ করা হয়েছে। ভারত সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০-এর অধীনে ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইন্টারেনট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্য ওয়ার ব্লক করে। এর আগে ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর প্রকাশ করার পর সরকারের চাপের মুখে দ্য হিন্দু খবরটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় বলে লন্ডনের টেলিগ্রাফের এক খবরে বলা হয়েছে।
ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম গতকাল ভুয়া একটি খবর প্রচার করে। সেটি হচ্ছে, পাঠানকোট সেক্টরে ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আঘাতে পাকিস্তানের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। আরো দাবি করা হয়, পাকিস্তানের একজন পাইলট আটক হয়েছেন। ভারতের গণমাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল বা এএনআইয়ের পরিবেশন করা এই খবর ভারতের গণমাধ্যমগুলো লুফে নেয়। কিন্তু পাকিস্তানের বিমান ধ্বংসের খবর অন্য কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিশ্চিত করেনি। পরে পাকিস্তানের সেনা মুখপাত্র ভারতের এই খবরকে ভুয়া ও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের মহাপরিচালক জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী ভারতকে সিনেমার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসার আহ্বান জানান।
ভারতের অন্য মূলধারার গণমাধ্যমগুলো পাক-ভারত সংঘাতে হতাহতের খবর প্রকাশ না করে উল্টো পাকিস্তানের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য প্রচারের অভিযোগ আনছে। পাকিস্তানের সব টেলিভিশন চ্যানেল, একাধিক ইউটিউব চ্যানেলÑ এমনকি পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত ব্লক করা হয়েছে।
ভারতের মানুষ যাতে যুদ্ধের আসল খবর জানতে না পারে, সেজন্য পাকিস্তানভিত্তিক খবরের প্রায় সব উৎস বন্ধ করেছে দিল্লি। এমনকি রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর এড়িয়ে যাচ্ছে ভারতের গণমাধ্যমগুলো। ভারতের রাফালে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো যখন নিশ্চিত খবর প্রকাশ করে, তখন ‘গদি মিডিয়া’ এই ঘটনাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়া ৮ মে পাকিস্তানের গণমাধ্যমে প্রকাশিত যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবর মিথ্যা বলে দাবি করে। পত্রিকার শিরোনাম দেওয়া হয়, ইন্ডিয়া ব্যাটেল ডিজ ইনফরমেশন ওয়ার আফটার সাকসেসফুল অপারেশন সিঁদুর। টাইমস অব ইন্ডিয়া যখন এই খবর প্রকাশ করে তার আগে ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে রয়টার্স, সিএনএন, আলজাজিরা তিনটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর প্রচার করেছে।
এদিকে পাকিস্তানের তথ্য যাতে ভারতীয়রা জানতে না পারে, সেজন্য ডন, জিও নিউজ, সামা টিভি, হাম টিভি, এআরওয়াইসহ একাধিক পাকিস্তানি টেলিভিশন ও ইউটিউব চ্যানেল ভারতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীরের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট ভারতে ব্লক করে দেওয়া হয়। হামিদ মীরের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকাকে জানান, ভারত সরকার আগে তার ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর তারা আমার এক্স অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছে। এর কারণ আমি তাদের কয়েকটি প্রোপাগান্ডামূলক খবর তুলে ধরেছিলাম।
ভারত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০২১-এর অধীন ডিজিটাল মিডিয়া অ্যাথিকসের আওতায় ওটিটি প্ল্যাটফরম ও ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা জারি করেছে। এর আওতায় পাকিস্তানি সব ধরনের সামাজিকমাধ্যমের প্রচারণার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এর আগে ইরশাদ ভাট্টি, আসমা শিরাজি, উমর চিমা এবং মুনিব ফারুকের মতো পাকিস্তানি সাংবাদিকদের ইউটিউব চ্যানেল নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি পাকিস্তানি ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব আখতার এবং বাসিত আলীর ইউটিউব চ্যানেল ভারত ব্লক করে দেয়।
ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভুয়া খবরের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে গাজার বিধ্বস্ত নৃশংসতার ছবি ও ভিডিও। তারা গাজার বিভিন্ন ধ্বংসযজ্ঞের ছবিকে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ভারতের মিসাইল হামলার ছবি বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। এমনকি অনেকে পাকিস্তানকে গাজা বানানোর আহ্বান জানাচ্ছে। গাজার মতো পাকিস্তানের মসজিদ ধ্বংসের ছবি ব্যাপকভাবে শেয়ার ও প্রচার করা হচ্ছে।
হিন্দুস্তান টাইমস ৮ মে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে হামলার যে ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সেটি ভুয়া। গাজায় ইসরাইলি হামলার একটি ছবি পাকিস্তানে হামলার বলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ছবিটি নিউইয়র্ক টাইমস তিন বছর আগে প্রকাশ করেছিল।
ডয়চে ভেলে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পাকিস্তানে মিসাইল হামলার যে ভিডিও ভারতের সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ছড়িয়ে দিয়েছে তার একটি ইসরাইলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দৃশ্য।
ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও চলছে মিথ্যা ও ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি। এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের দুটি চ্যানেলÑ আজতক ও রিপাবলিক বাংলা। এই দুই চ্যানেলে আবার পাক-ভারত যুদ্ধে বাংলাদেশকেও জড়ানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর খবরে ক্ষুব্ধ পশ্চিম বাংলাভিত্তিক আজতক। তারা একটি খবরের শিরোনাম করেছে, ‘পাকি চ্যালা বাংলাদেশের মিডিয়ার শয়তানি নিউজ দেখুন যুদ্ধে ভারত নাকি হারছে’। এই চ্যানেলের আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল পাক আর্মি চিফ আসিম মুনির গ্রেপ্তার। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির প্রোপাগান্ডা চ্যানেল রিপাবলিক টিভিতে পাকিস্তানভিত্তিক ভুয়া খবরের পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়ে চলছে নানা ধরনের মিথ্যা প্রচারণা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা নাকি বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আরেকটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে, পাকিস্তানের অবস্থা দেখে পথে আসছে বাংলাদেশ।
যুদ্ধ উন্মাদনার কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দিকে কোনো নজর নেই ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর। ভুয়া খবর প্রচারে লিপ্ত এসব সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভরতার কারণে পাক-ভারত সংঘাতের প্রকৃত চিত্র জানতে পারছে না ভারতের মানুষ।