
যে কোনো ইস্যুতেই মোদি সরকারের সামনে সংখ্যালঘু কার্ড ছাড়া যেন আর কোনো বিকল্পই নেই। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি টিকিয়ে রাখা, প্রতিবেশী দেশকে অযাচিত চাপে রাখা, নিজের ভাবমূর্তি বাড়ানো অথবা ড্যামেজ কন্ট্রোল-সব জায়গাতেই নরেন্দ্র মোদির একমাত্র অস্ত্র সংখ্যালঘু কার্ড। কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়া পেহেলগাম হত্যার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে পাকিস্তানে মিসাইল হামলা চালিয়েছে নরেন্দ্র মোদির দেশ ভারত। ভারতের এই হামলার ব্যাপারে
পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাফায়েলসহ ৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত, একটি ব্রিগেডসহ সীমান্তের বেশ কয়েকটি সেনাক্যাম্প ধ্বংস করা হয়। অন্যদিকে ভারতের হামলায় নিহত হয়েছেন নারী-শিশুসহ অন্তত ৩৬ বেসামরিক নাগরিক। ধ্বংস হয়েছে মসজিদ ও স্কুল। ফেস সেভিং বা মুখরক্ষার হামলা চালিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছে মোদি সরকার। অপরিণামদর্শী এই হামলা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাকফুটে ঢেলে দিয়েছে ভারতকে। ইসরাইল ছাড়া কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের পদক্ষেপকে ‘লজ্জাজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বড় ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে মোদি সরকার। মোদি সরকার এ মুহূর্তেও তার ড্যামেজ কন্ট্রোলে সেই সংখ্যালঘু কার্ডই খেললেন। পাকিস্তানের হামলার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্রিফিং করা হয়, সেখানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে যে দুজন সামরিক কর্মকর্তাকে হাজির করা হয়, তাদের মধ্যে একজন মুসলিম; অন্যজন শিখ সম্প্রদায়ের। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দুই সামরিক কর্মকর্তাই নারী। এদের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি; অন্যজন বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার বোমিকা সিং। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই সামরিক কর্মকর্তাকে দিয়ে মোদি সরকারের ব্রিফ করানোর বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে এখনো চলছে ব্যাপক আলোচনা। মোদি সরকার এই যুদ্ধাবস্থায় কেন খেললেন সংখ্যালঘু কার্ড-এ প্রশ্নের জবাবে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরই অংশ। মোদি এখন নানা ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছেন। বিশ্বে তার ভাবমূর্তি চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই সামরিক কর্মকর্তাকে সামনে এনে নিজের হারানো ভাবমূর্তি ফিরে পেতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। একইসঙ্গে তিনি দেখাতে চাইছেন তার নেতৃত্বে ভারত এখন ঐক্যবদ্ধ।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে আমার দেশকে বলেন, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দুই সংখ্যালঘু সামরিক কর্মকর্তাকে সামনে এনে নরেন্দ্র মোদি ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে চাইছেন। বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এম শহীদুজ্জামান এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, মোদি সরকার তার নিজের স্বার্থেই সব সময় সংখ্যালঘু কার্ড ব্যবহার করে থাকে। এখানেও ঠিক তা-ই করেছে।
উল্লেখ্য, গত মাসের ২২ তারিখে কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ নিরীহ পর্যটক নিহতের ঘটনাকে মোদি সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে তৎপর হয়। শুরুতেই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এটাকে ভারতের মাটিতে মুসলিমদের হাতে ‘হিন্দু হত্যা’ বলে প্রচারের মাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে উসকে দেওয়া হয়। সারা ভারতজুড়ে মুসলিমদের, বিশেষ করে কাশ্মীরি মুসলিমদের ওপর ব্যাপক হামলা শুরু করে বিজেপি সমর্থকরা। কাশ্মীরে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিমদের। অনেক মুসলিমের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মোদি সরকারের এই মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এ ব্যাপারে মোদি সরকারকে সতর্ক করেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক কূটনীতিক শশী থারুর। তিনি বলেন, গণহারে মুসলিমদের টার্গেট করা হলে হিতে বিপরীত হবে। এতে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়বে ভারত। শশী থারুরের এই পরামর্শ মোদি সরকার আমলে নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে মোদি সরকার তার ভাবমূর্তি রক্ষায় সেই সংখ্যালঘু কার্ডই ব্যবহার করলেন। অপারেশন সিন্দুরের ব্রিফিংয়ে তাই নিয়ে আসা হলো একজন মুসলিম ও একজন শিখ কর্মকর্তাকে। মুসলিমদের পাশাপাশি মোদি সরকারের টার্গেটে পড়েছে শিখ সম্প্রদায়ও। শিখ সম্প্রদায় এখন আন্তর্জাতিকভাবে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার। মোদি সরকার চাইছে অপারেশন সিন্দুরের ব্রিফিংকে সামনে এনে তার ভাবমূর্তি মেরামত করতে। অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, মোদি সরকার তার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্বার্থেই সব সময় সংখ্যালঘু কার্ড খেলে থাকে। এখানেও তা-ই করেছে। মোদি এখন নিশ্চিতভাবেই সংকটের মধ্যে আছেন। এখন মোদি সবাইকে তার পাশে পেতে চাইছেন। তিনি বিশ্বকে দেখাতে চাইছেন আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং আমরা সবাই ভারতীয়। এখানে সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই। তবে বাস্তবতা হলো মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিকাশে সংখ্যালঘু কার্ডই তার একমাত্র অস্ত্র।
অপারেশন সিন্দুরের ব্রিফিংয়ে নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুই সামরিক কর্মকর্তাকে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি তার ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে চেয়েছেন বলে জানান প্রফেসর দিলারা চৌধুরী। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ভারতের যে একটি ভাবমূর্তি ছিল, তা মোদির হাত ধরেই ধ্বংস হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে মোদির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন প্রশ্নের মুখে। কানাডায় শিখ নেতা হত্যার পর খালিস্তান আন্দোলন এখন তীব্র হচ্ছে। পাকিস্তানে হামলার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন শিখ সংগঠন। সব মিলিয়ে মোদি এখন প্রচণ্ড ভাবমূর্তি সংকটে। মোদি অপারেশন সিন্দুরের ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তার ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। তবে এই চেষ্টা সফল হবে বলে মনে হয় না।