
শহীদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর হিসাব নেবে পাকিস্তান। ভারতে সর্বদলীয় বৈঠক থেকে সেনাবাহিনীর অভিযানে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় পাল্টাপাল্টি লড়াই চলছেই পারমাণবিক অস্ত্রধর এই দুই দেশের মধ্যে। উত্তেজনার পারদ ক্রমশ বাড়ছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের লাহোরে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়ার দাবি করেছে ভারত। তারা বলেছে, পাকিস্তান ভারতের কমপক্ষে ১৫টি শহরে হামলা চালিয়েছে। টার্গেট করেছে সামরিক স্থাপনা। ভারতের একটি ড্রোন রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের কাছে আঘাত করেছে। ফলে ওই স্টেডিয়ামে করাচি-পেশোয়ারের ক্রিকেট ম্যাচ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই দেশের উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। বার বার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সংযত না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
মঙ্গলবার রাতে অপারেশন সিঁদুরের পর বুধবার রাতেও ব্যাপকভাবে পাকিস্তানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ভারত। পাকিস্তান তার ২৫টি গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি করেছে। ভারত দাবি করেছে তারা পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স রাডার ও বেশ কিছু সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। এগুলোর অবস্থান লাহোরে। তাদের দাবি, ভারতের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনাকে টার্গেট করেছে পাকিস্তান। তারা শ্রীনগর, পাঠানকোট, অমৃতসর, লুধিয়ানা, চণ্ডিগড় এবং অন্য স্থানগুলোতে টার্গেট করে হামলা করেছে। পাকিস্তানের হামলায় কমপক্ষে ১৬ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার তথ্য মিলেছে। ভারতের মিডিয়াগুলোতে বলা হয়েছে, হামলায় পাকিস্তানে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০০ মানুষ। তবে পাকিস্তান এ সংখ্যা ৩১ বলে উল্লেখ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার ভারতে সর্বদলীয় বৈঠক করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এ সময় সব বিরোধী দল ভারতের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছে। পাকিস্তান আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী বলেছেন, ভারত অপারেশন সিঁদুরের পর ড্রোন পাঠিয়ে আবারো নগ্ন আগ্রাসন চালিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ভারত-পাকিস্তানকে থামার আহ্বান জানালেও কাজ হচ্ছে না। ওদিকে এই লড়াইয়ে চীনের কোনো অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে দেশটি। ভারত দাবি করেছে, জম্মু-কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং গুজরাট সহ দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের ১৫টি শহরে সামরিক স্থাপনাকে টার্গেট করেছে বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার খুব সকালে। এর জবাবে পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স রাডার সিস্টেম ধ্বংস করে দিয়েছে ভারত। ওদিকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত করাচি বিমানবন্দরের সকল ফ্লাইট স্থগিত করে পাকিস্তান বিমানবন্দর রেগুলেটর। বিবিসি জানাচ্ছে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি মিথ্যা তথ্যের বিষয়ে কথা বলতে চান। সবাইকে তিনি স্মরণ করিয়ে বলেন, ভারত বিষয়টিকে উত্তেজনাকর করে তুলতে চাইছে না। কিন্তু ২২শে এপ্রিলের ভয়াবহ ছিল আসল উত্তেজনা। আর মঙ্গলবার রাতে যে বিমান হামলা করা হয়েছে, সেটা ছিল তার জবাব। তবে তিনি পাকিস্তানের বেশ কিছু অভিযোগের জবাব দেননি। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দাবি করেছেন, পাকিস্তানি সেনারা ভারতীয় ৫০ সেনাকে হত্যা করেছে। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্নও করা হয়নি। নিজে থেকেও বিক্রম মিশ্রি এ বিষয়ে কথা বলেননি। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতের ৫টি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তান।
এ বিষয়ে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি বিক্রম মিশ্রি। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে উপযুক্ত সময়ে অফিসিয়াল তথ্য জানানো হবে। ভারতের কিছু মিডিয়ার রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানে কমপক্ষে ১০০ উগ্রপন্থি নিহত হয়েছেন। এ বিষয়েও তিনি কোনো বক্তব্য রাখেননি। তিনি বলেন, বিমান হামলার মাত্র ৩৬ ঘণ্টা পার হয়েছে। বিস্তারিত জানতে অপেক্ষা করতে হবে। ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানের লাহোরে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। বিক্রম মিশ্রির কাছে জানতে চাওয়া হয় ভারত কী এমন অন্য কোনো সিস্টেম টার্গেট করেছে। জবাবে তিনি বলেন, অপারেশন নিয়ে বিস্তারিত বলবেন না। এদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে এক বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, প্রত্যাঘাতের পর পরিস্থিতি আরও জটিল করতে আগ্রহী নয় নয়াদিল্লি। তবে পাকিস্তান সামরিক আক্রমণ করলে ভারত তার যোগ্য জবাব দেবে।
জাতির উদ্দেশ্যে শেহবাজ, শহীদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর হিসাব নেয়া হবে: ভারতের হামলার জবাবে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া টেলিভিশন ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ বলেছেন- শহীদদের প্রতিটি রক্তবিন্দুর হিসাব নেয়া হবে। তিনি ভারতের এই ‘আগ্রাসন’কে মারাত্মক ভুল হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ভারত ভেবেছিল পাকিস্তান পিছু হটবে। কিন্তু তাদের (ভারত) এই ভুলের মূল্য চুকাতে হবে। শেহবাজ বলেন, ভারত ভুলে যায়, পাকিস্তানের বীর সন্তানেরা মাতৃভূমির সম্মান রক্ষায় নিজেদের রক্তের শেষ ফোঁটা দিয়ে লড়াই করেছে এবং করবে। তিনি জানান, পাকিস্তান বিমান বাহিনী এক ঘণ্টার লড়াইয়ে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে, যা একসময় ভারতের গর্ব ছিল। এখন সেগুলো শুধু ছাই ও ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর হামলার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে টেলিভিশনে ভাষণ দেন। এতে তিনি বলেন, শহীদ ইরতেজা আব্বাস মাত্র সাত বছর বয়সী একটি শিশু। সে নিজের ঘরে পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করছিল। সেখানে স্প্লিন্টারের আঘাতে শহীদ হয়। একটি কোমল ফুল ঝরে গেছে। কিন্তু সে শহীদের মর্যাদা পেয়েছে।
শেহবাজ শরীফ আরও বলেন, ভীরু শত্রু নিরীহ মানুষের ওপর আঘাত করছে। পাকিস্তান দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। তিনি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও সাহসিকতার প্রশংসা করে বলেন, মার্শাল এম এম আলমের বজ্রধ্বনি যেন আজও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব জয়েন্ট চিফসের চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল অসিম মুনির, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জাহির বাবর সিদ্দিক এবং নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ সহ সব অফিসার ও সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, পেহেলগাম হামলা নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
পাকিস্তান একটি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছিল, যা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম ভেঙে হামলা চালিয়েছে। কাশ্মীর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশ্মীর একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বিরোধপূর্ণ এলাকা ছিল এবং থাকবে। ভারত যত সিদ্ধান্তই নিক, বাস্তবতা বদলাতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, যেখানে প্রায় ৯০,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৫২ বিলিয়ন ডলার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারতের আগ্রাসন আমাদের দৃষ্টি সন্ত্রাসবাদ নির্মূল থেকে সরাতে পারবে না। সবশেষে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণ একতাবদ্ধ। জাতি তার বীর সেনাবাহিনীর পাশে আছে এবং সম্মিলিতভাবে শত্রুকে পরাজিত করবে।
দিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধী নেতাদের সমর্থন ঘোষণা: ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠকে দেশের প্রধান বিরোধী নেতারা সরকারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বৈঠকে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে চালানো বিমান হামলার বিষয়ে বিরোধী দলগুলোকে অবহিত করেন। সংবাদ মাধ্যমকে এ কথা জানিয়েছেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। তিনি আরও বলেন, বিরোধী নেতারা এ বিষয়ে নানা পরামর্শও দিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সংবাদ সংস্থা এএনআই’কে জানান, সরকার বলেছে- কিছু বিষয় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন রাখা প্রয়োজন। আমরা সবাই বলেছি, আমরা সরকারের পাশে আছি।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানান, তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, ভারত যেন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’-এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার চালায়। দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টকে ভারত গত মাসে পেহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করেছে। ভারত সরকারের মতে, দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট হলো পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। একে জাতিসংঘ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
পাকিস্তানে ১০০ হত্যার দাবি রাজনাথের: এনডিটিভি’র খবরে বলা হয়, সর্বদলীয় বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, পাকিস্তানে ভারতের সামরিক জবাবে কমপক্ষে ১০০ ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, অপারেশন সিঁদুর চলমান অপারেশন। এর অর্থ হলো পাকিস্তান কোনো ‘উত্তেজনা’ সৃষ্টি করলে তার জবাব দিতে প্রস্তুত আছে ভারতের সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, যদি শত্রুরা আর হামলা না করে তাহলে ভারত আর কোনো সামরিক পদক্ষেপে যেতে চায় না।
ভারতের ৫০ সেনা নিহত, দাবি পাকিস্তানের: ভারতের ৫০ সেনা সদস্য নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। দেশটির তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, ভারত শাসিত ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরকে বিভক্তকারী নিয়ন্ত্রণ রেখায় গোলাগুলির সময় ৪০ থেকে ৫০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন। পাকিস্তানের আইএসপিআর জানিয়েছে, ৬ মে পাকিস্তানের পাল্টা বিমান হামলায় ভারতের পাঁচটি আধুনিক যুদ্ধবিমান, একাধিক ড্রোন ধ্বংস এবং সেনা হতাহতের ঘটনায় ভারত ‘ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে’ এসব ড্রোন হামলার আশ্রয় নেয়।