Image description

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে চালানো হামলার পর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী, লক্ষ্য ছিল—হামাসকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করা, ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্ত করা এবং গাজাকে ভবিষ্যতের হুমকি হিসেবে মুছে ফেলা।

এর জবাবে ইসরায়েল ইতিহাসের বৃহত্তম সামরিক অভিযানে নামে। প্রায় পাঁচ লাখ সৈন্য মোতায়েন করা হয় এবং ১ লক্ষ টনের বেশি বিস্ফোরক গাজায় ফেলা হয়।

কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হলেও প্রধান কোনো লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। হামাস এখনও সক্রিয়, বহু ইসরায়েলি এখনও বন্দি, আর গাজায় মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হচ্ছে।

সামরিকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় ইসরায়েলের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা দাবি করছে—শান্তি ও আঞ্চলিক স্থিতির পূর্বশর্ত হিসেবে হামাসের পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ। তবে এই দাবির পেছনে যে বাস্তবতা রয়েছে, তা অনেক বেশি জটিল ও বিভ্রান্তিকর।

গাজার কাছে যুদ্ধবিমান, ট্যাংক বা ব্যালিস্টিক মিসাইল নেই—তাদের অস্ত্র সীমিত, মূলত স্থানীয়ভাবে তৈরি। এমন এক জায়গায় হামাসের সামান্য আত্মরক্ষার উপকরণ মুছে ফেলার শর্তে শান্তির কথা বলা মূলত ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার শামিল।

সাধারণত কোনো যুদ্ধের শেষে, বিরোধী পক্ষ আত্মসমর্পণ করলে নিরস্ত্রীকরণের দাবি তোলা হয়। কিন্তু গাজায় এমন কোনো পরিস্থিতি দেখা যায়নি। বরং এটি ইসরায়েলের কৌশলগত ব্যর্থতারই প্রতিফলন।

হামাস শুধু একটি সংগঠন নয়—এটি বহু দশকের দখল, উৎখাত ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পটভূমিতে ফিলিস্তিনি সমাজের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। তাই হামাসকে নিরস্ত্র করলেও প্রতিরোধ শেষ হবে না; বরং নতুন গোষ্ঠী সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে।

হামাস পিএলও নয়, গাজাও বৈরুত নয়। ৮০-এর দশকে লেবাননে পিএলও-র অস্ত্র হস্তান্তরের ইতিহাস গাজায় প্রয়োগ করা অনুপযুক্ত। হামাস বিদেশি নয়, বরং সেই জমিতে জন্ম নেওয়া, যেখান থেকে তারা পরিচালিত হয়। তারা শুধু সুরঙ্গ বা রকেট দিয়ে টিকে নেই—তারা টিকে আছে প্রতীকী শক্তি হিসেবেও।

ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রতিরোধ কোনো আদর্শিক বিলাসিতা নয়—এটি অস্তিত্বের সংগ্রাম। ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু, গুঁড়িয়ে যাওয়া শহর আর প্রজন্মব্যাপী ট্রমা নিয়ে তাদের কাছে অস্ত্র ছাড়ার অর্থ নিরাপত্তা নয়, বরং নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা।

ইসরায়েল যতই হামলা চালাক, তা হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করে বরং নতুন প্রতিরোধ উসকে দিচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও এই যুদ্ধের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে।

ইতিহাসও নিরস্ত্রীকরণকে নিরাপত্তার পথ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্রেব্রেনিৎসা ও সাবরা-শাতিলা হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহতা এসেছিল নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার ফারাক থেকেই। পশ্চিম তীরেও নিরস্ত্রীকরণ হয়েছে, কিন্তু বসতি বিস্তার, অভিযান আর সহিংসতা কখনও থামেনি।

নেতানিয়াহুসহ অনেক ইসরায়েলি কর্মকর্তার বক্তব্যে বারবার স্পষ্ট হয়—তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের চিরতরে উৎখাত। সেই বাস্তবতায় ফিলিস্তিনিরা একটাই প্রশ্ন তোলে: “কেন নিরস্ত্রীকরণে রাজি হব, যদি তা যুদ্ধ থামায় না, নিরাপত্তা দেয় না, নির্মাণ ফেরায় না? অস্ত্র ছাড়লে কি আরেকটি নাকবা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে না?”

সর্বশেষ শিক্ষা হলো—কোনো নিরস্ত্রীকরণ, কোনো সমাধান টিকবে না, যদি দখল, উৎখাত ও অধিকার হরণ বন্ধ না হয়। বাস্তব রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া শুধু অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া মানে আরও অস্থিতিশীলতা তৈরি করা।

আসল শান্তি আসবে মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব ও পারস্পরিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে। তাই অস্ত্র নয়, প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোতা।