Image description

মার্কিন শাসকগোষ্ঠী ও নীতি-নির্ধারকদের যে অংশ বুশ প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা করেছিল ২০০৮ ও ২০১২’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামার বিজয়ী হওয়ার পেছনে তাদের বিশেষ অবদান ছিল। প্রথম দফায় ৭৬ কোটি ডলার এবং দ্বিতীয় দফায় ৯৮ দশমিক ৬ কোটি ডলার খরচ করে ওবামাকে তারা জিতিয়ে এনেছিল।

এরা মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধে আটকে থাকার সুযোগে চীন দ্রুত সারা বিশ্বে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করেছে। এক দশকের মধ্যে ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে উন্নীত হয়েছে।
পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন বাণিজ্যের অংশীদারিত্ব যেখানে শতকরা ১৯ দশমিক ৫ ভাগ থেকে ৯ দশমিক ৫ ভাগে নেমে এসেছে সেখানে চীনের অংশীদারিত্ব ১০ দশমিক ২ থেকে বেড়ে হয়েছে শতকরা ২০ ভাগ। বহুল প্রচারিত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান’ এবং ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ নামে চীনের যে অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে বিশ্বে চীনের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছানো ঠেকানো সম্ভব হবে না।

সুতরাং দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এই নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন চীনের প্রতি মনোযোগ না বাড়ালে একুশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বিশ্বে নিজের আধিপত্য ধরে রাখা কঠিন হবে। সুতরাং এ মুহূর্তে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভূরাজনীতি হচ্ছে ‘চীন ঘেরাও’ এবং একে ঘিরে এ অঞ্চলে তাদের সামরিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা জোরেশোরে চলছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অস্ত্র বিক্রি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আপাতত তেমন কোনো লাভ নেই। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন ভারতে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়েছে। তা তারা দু’হাজার উনিশ সালেও করেছিল। এই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই সেবার প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যে এরকমই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু পরে এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। এবারও তেমনই ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওবামা প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছিল। বিশাল ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল নিয়ে ওবামা দু’বার ভারত সফর করেছেন এবং দু’বারই একাধিক বাণিজ্য চুক্তি সই করেছেন। এ সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পরিষদে ভারতের সদস্যপদের দাবিকেও তিনি সমর্থন করেছেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং জন কেরিও ভারত সফর করেছেন।

তখন ওয়াশিংটনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পানিকর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’ সংক্ষেপে ‘লেমোয়া’ নামে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছেন। আরও দুটি চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় ছিল। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের অনেক কারণের মধ্যে মূল কারণ হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের বেড়ে চলা ক্ষমতা ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে ভারতকে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে ভারতকে তার প্রয়োজন। বাংলাদেশও এ প্রয়োজনের বাইরে নয়। সুতরাং কোথাকার পানি কোথায় গড়াতে পারে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখার চেষ্টা থাকা ভালো।
লেমোয়া চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন এ চুক্তির ফলে একদিকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়বে, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হবে। অবিশ্বাস বাড়বে। মাস না পেরোতেই ভারত-পাকিস্তানের ভালনারেবল ভূখণ্ড কাশ্মীর জ্বলে উঠেছিল। চলেছিল হুমকি পাল্টা হুমকি। সঙ্গে জাতীয়-আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় একপেশে ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার।
পাকিস্তানের অন্য অশান্ত অঞ্চল বেলুচিস্তানও সেসময় নতুন করে ফুঁসেছিল। লন্ডনে বেলুচ ছাত্র সংগঠন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। চীনের সরকারি প্রচার মাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর এক আর্টিকেলে বেলুচিস্তানকে নতুন করে অশান্ত করার জন্য সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। চীনের অনেক স্বার্থ রয়েছে বেলুচিস্তানের সঙ্গে। ভারতের অরুণাচলে ক্ষেপণাস্ত্র এবং লাদাখে ট্যাঙ্ক মোতায়েনের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও গোপনে তিব্বতে সামরিক প্রস্তুতি বাড়াতে শুরু করেছিল।
দক্ষিণ এশিয়াকে অশান্ত করতে বা এ অঞ্চলে যুদ্ধ সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিক এবং সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়িয়ে দুদেশে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা। কারণ ভূখ-, জনসংখ্যা, সামরিক শক্তি ও অর্থনীতির দিক থেকে এ অঞ্চলে এ দুদেশের প্রাধান্য রয়েছে। এদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওঠা-নামার সঙ্গে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা জড়িত। তা নষ্ট করতে ছাইচাপা আগুন কাশ্মীর রয়েছে।

একটু ঘি ঢাললে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা মুহূর্তের ব্যাপার। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব সেই ভারত ভাগের সময় থেকে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ কারও ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্রিটিশরা নিজেদের পরিকল্পনামতো ভারত ভাগ করেছিল। কাশ্মীর নিয়ে তারা যে চাতুরী করেছিল তার কুফল আজও ভোগ করছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর স্বাধীন রাষ্ট্র দুটো চাইলে এ সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারত।

সে সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জাতিসংঘকে কাশ্মীর ভারত না পাকিস্তান কোন পক্ষে যাবে এ নিয়ে গণভোট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি। কারণ তিনি জানতেন এতে কাশ্মীর ভারতের হাতছাড়া হবে। এরপর জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক অন্য কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি।

দুদেশের শাসকগোষ্ঠীও হয়তো তা চায়নি। কারণ এ টানাপোড়েনে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হলেও শাসকগোষ্ঠীর বহুমুখী লাভ। এমন সাংঘর্ষিক অবস্থা বজায় থাকলে দুদেশেই সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ে। তাতে অস্ত্র বেচাকেনার ব্যবসায়িক দিকটি আন্তর্জাতিকভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আগের মতো নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত শতকের শেষ পর্যন্ত ইউরোপ ঘিরেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা আবর্তিত হয়েছে। সে সময় ন্যাটো ছিল তাদের প্রধান যুদ্ধজোট। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করতে এ জোট গঠিত হয়েছিল। তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক জোট গঠন এবং এ দেশগুলোসহ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের যুদ্ধনীতি বাস্তবায়ন করেছে।

অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে তখন বিশ্বময় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তার। ডলার ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মুদ্রা। এখন সে অবস্থা নেই। এখন তাকে কৌশল বলাতে হচ্ছে। এশিয়ায় তাদের মনোযোগের কেন্দ্র যেহেতু চীন তাই এ অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়াতে চীন ঘিরে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটবে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। সরাসরি আক্রমণ নয় বরং যুদ্ধই যেন চলে আসে চীনের দুয়ারে কৌশলটা তেমন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ অঞ্চলের দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এমন জটিল যে, সরাসরি যুদ্ধ করে একে মোকাবিলা করা কঠিন। যেমন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্সসহ আসিয়ানভুক্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও তারা ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ইরান প্রস্তাবিত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে তাদের চাবাহার বন্দর যুক্ত করতে আগ্রহী।
তাদের কৌশল হচ্ছে দুদিকে সম্পর্ক বজায় রাখা দেশগুলো যাতে তাদের বেছে নেয় এমন অবস্থা সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করা। এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি- আমার সঙ্গে না থাকলে বিপদ বাড়বে। 
তাদের পরিকল্পনা যে কত সুদূরপ্রসারী অনেকেরই সে সম্পর্কে ধারণা আছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সেই পাঁয়তারা চলছে বলে অনেকে মনে করছেন।