Image description

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্যাণে ট্যারিফ নামের অর্থনীতির এই পরিভাষা এখন সবাই জেনে গেছেন। ট্যারিফ মূলত শুল্ক, যা একটি দেশ অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপ করে। সেই প্রাচীন গ্রিসে শস্য আমদানির ক্ষেত্রে ২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। সেটাকেই বিশ্বে প্রথম ট্যারিফ বলা হয়। শুরুতে এই ট্যারিফ বা শুল্ক মূলত আরোপ করা হতো রাজস্ব আদায় বাড়াতে। এর বাইরে ট্যারিফ বসানো হয় স্থানীয় শিল্পকে সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য। আর এখন ট্যারিফ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে বাণিজ্যনীতি প্রয়োগের একটি অস্ত্র হিসেবে।

একটা সময় ছিল, যখন বিশ্বব্যাপীই রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস ছিল এই ট্যারিফ। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। ১৭৯৮ থেকে ১৯১৩ সময়ে ট্যারিফ বা আমদানি শুল্ক থেকে আয় ছিল তাদের মোট ফেডারেল আয়ের ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। আর এখন সেই আয় কমে হয়েছে ২ শতাংশ। যেমন ২০২৪ সালে ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন বিভাগের আমদানি শুল্ক বা ট্যারিফ থেকে আয় ছিল ৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির সরকারের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

১,০২৮ জন অর্থনীতিবিদ ট্যারিফ বিলে ভেটো দিতে বলেছিলেন
১,০২৮ জন অর্থনীতিবিদ ট্যারিফ বিলে ভেটো দিতে বলেছিলেন

আসলে ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সংরক্ষণবাদ থেকে আস্তে আস্তে সরে এসেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) প্রতিষ্ঠার আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ভূমিকা ছিল। দেশটিতে ৭০ শতাংশ পণ্য যায় বিনা শুল্কে। সেই যুক্তরাষ্ট্রই এখন বিশ্বজুড়ে শুরু করে দিয়েছে ট্যারিফ–যুদ্ধ।

আগেও বিপর্যয় হয়েছিল

রাজস্ব আয় বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স বা আয়করব্যবস্থা চালু করেছিল ১৯১৩ সালে। তখনো আয়ের মূল উৎস ছিল নানা ধরনের আমদানি শুল্ক। তবে যুক্তরাষ্ট্র বড় আকারে ট্যারিফ–যুদ্ধ শুরু করেছিল ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময়। এর আগেই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ শুল্ক আরোপ করে রেখেছিল। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে কংগ্রেস ফোর্ডনি-ম্যাককাম্বার অ্যাক্ট পাস করেছিল, যার মাধ্যমে ট্যারিফের হার ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ওয়ারেন জি হার্ডিং। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ২৯তম প্রেসিডেন্ট।  

ইউরোপের দেশগুলো তখনই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। এর মধ্যে অবশ্য ইউরোপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা শুরু করে এবং কৃষিপণ্য উৎপাদনও বাড়তে থাকে। এতেই সমস্যা বৃদ্ধি পায় যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য উৎপাদকেরা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে এবং অতিরিক্ত উৎপাদন হওয়ার কারণে কৃষিপণ্যের দামও কমে যায়। তখনই দেশটির কৃষিপণ্যকে সংরক্ষণ করার জোরালো দাবি উঠতে থাকে।

সিনেটর ইউলিস হাওলি ও রিড স্মুট
সিনেটর ইউলিস হাওলি ও রিড স্মুট

১৯২৮ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ছিলেন হারবার্ট হুবার। তিনি প্রচারণার সময় কৃষিপণ্যকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নিজ দলের সদস্যদের কাছ থেকেই অর্থনীতির সব খাতে সংরক্ষণের চাপ বাড়তে থাকে। তবে এ–সংক্রান্ত আইন সিনেটে পাস করা যায়নি।

পরিস্থিতি বদলে যায় ১৯২৯ সালে শেয়ারবাজারের ধস নামলে। এই ধস থেকে দেখা দেয় মহামন্দা। সংরক্ষণবাদীরা তখন শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ট্যারিফ বাড়িয়ে মার্কিন পণ্যকে সংরক্ষণ দিতে দ্য স্মুট-হাওলি ট্যারিফ অ্যাক্ট ৪৪-৪২ ভোটে পাস হয়। অন্তত এক হাজার অর্থনীতিবিদ সে সময় এই আইনে ভেটো দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কারও কথাই শোনা হয়নি। ১৯৩০ সালের ১৭ জুন আইনটি কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে সব দেশের জন্য ট্যারিফ আরও ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়।

যেভাবে পরাজয় ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের

সেবার অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ–যুদ্ধের পরিণতি ভালো হয়নি; বরং তিক্ত বাণিজ্যযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। দ্য স্মুট-হাওলি ট্যারিফ অ্যাক্ট পাস হওয়ার দুই বছরের মধ্যে ইউরোপের বড় বড় অর্থনীতির দেশ সমানসংখ্যক পাল্টা–শুল্ক আরোপ করে। পাল্টা–ট্যারিফ আরোপের ফলে ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে বিশ্ববাণিজ্য দুই-তৃতীয়াংশ কমে যায়। বহুসংখ্যক ব্যাংকের পতন ঘটে। বলা হয়, বিশ্ববাণিজ্যে একা হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে হেরে যান হারবার্ট হুবার। নতুন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট দায়িত্ব নিয়েই ট্যারিফ কমানোসহ এ থেকে বের হতে আলোচনা শুরু করেন। অবশেষে ১৯৩৪ সালে রেসিপ্রোকাল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টস অ্যাক্ট পাস করা হয়। এর মাধ্যমে শুল্কহার কমান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং বাণিজ্য উদারীকরণকে এগিয়ে নেন। অর্থাৎ প্রথম ট্যারিফ–যুদ্ধে পরাজয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের।

এটা ঠিক যে দ্য স্মুট-হাওলি ট্যারিফ অ্যাক্টের কারণে ১৯৩০ সালের মহামন্দা হয়নি। শেয়ারবাজার ধস থেকে মহামন্দার শুরু। তবে এই আইন মহামন্দাকে আরও গভীর করছিল। সেই যুক্তরাষ্ট্র আবারও ট্যারিফ–যুদ্ধ শুরু করেছে। এর পরিণতিও কি ১৯৩০ সালের মতোই হবে? ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি ঘটবে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।