
লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের সম্প্রতি যে বৈঠক হয়েছে, তা নিয়ে সবার মধ্যেই কৌতূহল ও নানা আলোচনা চলছে। হঠাৎ দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের পর রাজনীতির গতিপথে পরিবর্তন আসতে পারে বলেও নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে।
বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে দল দুটির নেতাকর্মীরা ওয়াকিফহাল না হলেও গত দুই দিনে তাদের সম্পর্কের বৈরিতা কিছুটা হলেও কম দেখা যাচ্ছে। বৈঠক ফলপ্রসূ হলে দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলা উত্তেজনা কমে আসবে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
গত রবিবার লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনের বাসায় এই বৈঠক হয়। এ সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়, বিভিন্ন বিষয়ে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে যে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা হয়েছে তা স্বীকার করেছেন জামায়াত আমির। তিনি বলেন, রাজনীতিকরা এক জায়গায় বসলে রাজনৈতিক কথা হবে না—এটা বাস্তব নয়। রাজনৈতিক কথা হয়েছে, তবে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়। নির্বাচন ও বিচার সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা হলেও তাঁরা বৈঠকের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা হয়তো সৌজন্য বৈঠক।
বিএনপি নেতারাও বলছেন, দুই রাজনীতিক একসঙ্গে বসলে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা হবে। কথা বলতে না চাইলেও মনের অজান্তেই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ চলে আসবে। তাই ধারণা করা যায়, বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন রাজনীতিবিদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদরা নয়। রাজনীতিবিদের প্রতিদ্বন্দ্বী অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা। বাংলাদেশে এখন বিরাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা আবার শুরু হয়েছে। নতুন একটি শক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যে ধরনের মতপার্থক্যই থাকুক না কেন, এই বাস্তবতা উপলব্ধি সবাই করতে পারে।
দল দুটির সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে সংসদ নির্বাচন, সংস্কার, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এবং সর্বোপরি সরকারের কার্যক্রম নিয়ে কথা হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট করে কোনো পক্ষই আলোচনার বিষয়বস্তু প্রকাশ করেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী সপ্তাহখানেক দুই রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে বৈঠকের বিষয়গুলোর আলোচনা সামনে আসতে শুরু করবে।
ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে প্রায় ১১ দিনের সফর শেষ করে গত সোমবার শফিকুর রহমান দেশে ফেরেন। বুধবার গুলশানে মার্কিন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াত আমির বলেন, ‘আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা (নির্বাচন) রমজানের আগেই শেষ করতে হবে। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড়ঝাপটা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা (নির্বাচন) অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সে জন্য আমরা চাইছি, ওই আশঙ্কার আগেই যেন নির্বাচন হয়ে যায়।’
গতকাল রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে শফিকুর রহমান অবশ্য আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনটি ‘ম্যান্ডেটরি’ (বাধ্যতামূলক) দাবি পূরণ হলেই আগামী রোজার আগে নির্বাচন হতে পারে।
গত বুধবার পুরানা পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে ‘সমমনা ইসলামী দলসমূহের’ এক বৈঠক থেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছেন, চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এত দিন এই দলগুলো সংস্কারের আগে নির্বাচনের বিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছে। কেউ কেউ বিএনপির বারবার নির্বাচনের দাবির সমালোচনাও করেছে।
জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে হঠাৎ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী দলগুলোর কাছাকাছি অবস্থানকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠকের ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁরা বলেন, ওই বৈঠকে কোনো বিষয়ে ন্যূনতম একমত না হলে এই ধরনের বক্তব্য আসত না।
এ বিষয়ে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন এবং অনির্বাচিত সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় রাখার নানামুখী চেষ্টাও আছে। আর সেটি হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি ও জামায়াত। সেই উপলব্ধি থেকে নানামুখী চক্রান্ত নস্যাৎ করতে দুই দলের ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা থেকে এই বৈঠক হতে পারে।
জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ২০১৯-২০ সালের দিকে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে শফিকুর রহমানের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে গোয়েন্দাদের তৎপরতার কারণে তা হয়নি। গত কিছুদিনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যে শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে, তাতে এই সময়ে এই বৈঠক কেউ প্রত্যাশা করেনি। নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণে রাজনীতিবিদদের কাছে আসতে হয়। এর মাধ্যমে আবার প্রমাণ হলো, রাজনীতিতে শেষকথা বলতে কিছু নেই।
কারো কারো ধারণা, বৈঠকে জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হতে পারে। কারণ অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তারেক রহমানের খুবই বিশ্বস্ত আসাদুজ্জামান। সে জন্য নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়ে যাতে তিনি বাধা হয়ে না দাঁড়ান, সেটিও প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় আসতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন এমন একজন নেতা বলেন, চলমান রাজনীতির দেশীয় প্রধান অংশীদার হচ্ছে বিএনপি। তারপর জামায়াত ও এনসিপি। এরপর অন্য দলগুলো। পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বাহিনী। আন্তর্জাতিক শক্তিদের মধ্যে অংশীদার হচ্ছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান। এর বাইরে যারা নির্বাচন চায় না কিংবা সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায় এমন দল হচ্ছে এনসিপি ও কয়েকটি অদৃশ্যমান শক্তি। সেই শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে অঙ্গীকার করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতসহ বেশির ভাগ দলের নির্বাচন সময়ের দাবি খুবই কাছাকাছি। সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের যে কথা বলেছেন, সেই হিসাবেও ডিসেম্বর মনে করা হচ্ছে। এই অংশীদারদের কাছাকাছি আনতে কারো মধ্যস্থতায় হয়তো খালেদা জিয়া ও শফিকুর রহমানের বৈঠক হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন কালের কণ্ঠকে বলেন, যত দিন গড়াবে, নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা বৈঠক হবে। জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বেশির ভাগ দল এত দিন নির্বাচনের আগে সংস্কার চাইলেও এখন বক্তব্য ভিন্ন রকম মনে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য হলেও তা কতটুকু টেকসই হবে, তা সময়ই বলে দেবে।