Image description

গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রাথমিক অবসান ঘটানোর বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ট্রাম্প। 

তখন ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা জিতলে খুব দ্রুত এর (ইউক্রেন যুদ্ধ) সমাধান করতে পারব বলে মনে করি।’ কিন্তু তিনি কত দ্রুত সময়ের সঙ্গে তা করবেন তা স্পষ্ট ছিল না।

 

ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছেন দুই মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবশেষে হোয়াইট হাউস হয়তো বুঝতে পেরেছে, তিক্ত এবং জটিল এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে সময় লাগতে পারে।

 

ট্রাম্পের প্রসাশনের প্রত্যাশার চেয়ে ধীর অগ্রগতিতে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত ক্ষমতার ওপর অগাধ বিশ্বাস, একের পর এক কূটনীতিও হয়তো ভুল পথে চলে গেছে।

 

গত ১২ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প প্রথম ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। দেড় ঘন্টার ওই কথোপকথনকে তিনি ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ বলেই বর্ণনা করেছিলেন। এরপর ১৮ মার্চ এই দুই নেতা আবার ফোনে কথা বলেন।
কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, টেলিফোনে এই কথোপকথনগুলো ট্রাম্পের চাওয়া তাৎক্ষণিক ৩০ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।

পুতিনের কাছ থেকে তিনি একমাত্র যে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন তা হলো, ইউক্রেনীয় জ্বালানি সুবিধাগুলোতে রুশ আক্রমণ বন্ধ করা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিও ইউক্রেন তাকে ফোন করার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

দ্বিতীয়ত, রুশ প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করতে চান না। গত সপ্তাহে ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার এক মাস পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আলোচনা সম্পর্কে প্রথম এ মন্তব্য করেছিলেন। 

পুতিন দেখিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তি সম্পর্কে কথা বলার আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন যুদ্ধবিরতি চাওয়ার মার্কিন দ্বি-পর্যায়ের কৌশলের তিনি দৃঢ় বিরোধিতা করছেন। পরিবর্তে, তিনি যেকোনো আলোচনায় ‘যুদ্ধের মূল কারণ’ হিসেবে যা দেখা হয়, তার সমাধান চেয়েছেন। 

যেমন পুতিনের আশঙ্কা ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণ এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি বিস্তারিত প্রশ্ন এবং শর্তাবলীও তুলে ধরেন, যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে এবং যেকোনো চুক্তিতে সম্মত হওয়ার আগে অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

তৃতীয়ত, ইউক্রেনের ওপর প্রাথমিক মার্কিন কৌশল ভুল বিবেচিত হতে পারে। হোয়াইট হাউস এই বিশ্বাসে ছিল যে, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিই শান্তি চুক্তির পথে বাধা। পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে বিশ্ব কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, তা বুঝতে ইউক্রেনীয় সরকারের বেশ দেরি হয়েছে। 

কিন্তু কিয়েভের ওপর মার্কিন চাপের ফলে ওভাল অফিসে যে বাকবিতন্ডা সৃষ্টি হয়েছিল, তা সকল প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক মূলধন নষ্ট করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। এ সময় জেলেনস্কির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অকৃতজ্ঞতা ও রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অনীহা দেখানোর অভিযোগ তোলা হয়।

এ ঘটনা ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ককেও ভেঙে দেয়। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মতবিরোধের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যা আরেকটি কূটনৈতিক সমস্যা এবং সমাধান করতেও সময় লাগে। এই সময় ভ্লাদিমির পুতিন বসে বসে সেই ঘটনা উপভোগ করেছিলেন।

চতুর্থত, সংঘাতের জটিলতা যেকোনো সমাধানকে কঠিন করে তোলে। ইউক্রেনীয় প্রস্তাবটি ছিল প্রাথমিকভাবে আকাশ এবং সমুদ্র পথে একটি অন্তর্বর্তীকালীন যুদ্ধবিরতি। যা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। 

কিন্তু গত সপ্তাহের জেদ্দায় আলোচনায় আমেরিকা জোর দিয়ে বলেছিল, যেকোনো তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির মধ্যে পূর্বের ১ হাজার ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ ফ্রন্ট লাইনও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাৎক্ষণিকভাবে এটি যেকোনো যুদ্ধবিরতি যাচাইয়ের রসদকে আরো জটিল করে তুলেছিল। অবশ্যই, পুতিন তখন এটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর আক্রমণ বন্ধ করার জন্য আরো সাধারণ প্রস্তাবেও পুতিনের সম্মতি দিতে সমস্যা ছিল। 

সোমবার সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রযুক্তিগত আলোচনার বেশিরভাগ অংশই এই প্রস্তাবের বিশদ বিবরণে থাকবে। সামরিক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পারমাণবিক বা অন্য কোন বিষয়ে এর বিস্তারিত তালিকা তৈরি করবেন। কেন অস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করা উচিত নয় তা নিয়েও একমত হওয়ার চেষ্টা করবে। 

তবে জ্বালানি এবং অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামোর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে কিছুটা সময় লাগতে পারে। এটা মনে রাখা ভালো যে, ইউক্রেন এবং রাশিয়া একে অপরের সঙ্গে কিন্তু কথা বলছে না। তারা পৃথকভাবে এবং দ্বিপাক্ষিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করছে। যা আরো সময় নিচ্ছে। 

পঞ্চম, মার্কিন মনোযোগ যুদ্ধ শেষ করার অগ্রাধিকার থেকে সরে গিয়ে যুদ্ধবিরতির অর্থনৈতিক সুবিধার ওপর বেড়েছে। ট্রাম্প মার্কিন সংস্থাগুলোকে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য একটি চুক্তিতে আসার চেষ্টা করছে। এর জন্যও প্রচুর সময় ব্যয় হচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে ইউক্রেনের ভবিষ্যতে মার্কিন বিনিয়োগ হিসেবে দেখছেন। আর অন্যরা এটিকে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন হিসেবে দেখছে।

প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রথমে যুক্তি দিয়েছিলেন, তিনি কেবল তখনই একটি চুক্তিতে সম্মত হবেন, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে তার দেশে রুশ আগ্রাসন রোধ করার জন্য ইউক্রেনকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিবে। কিন্তু হোয়াইট হাউস তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, মার্কিন খনি সংস্থা এবং কর্মীদের উপস্থিতিই ইউক্রেনে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতির জন্য যথেষ্ট। 

অবশেষে জেলেনস্কি পরাজয় স্বীকার করে বলেছিলেন, তিনি সুরক্ষা গ্যারান্টি ছাড়াই একটি খনিজ চুক্তিতে সম্মত হবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। বরং আবারও শর্তাবলী উন্নত করার আশায়, সম্ভবত ইউক্রেনীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশ এমনকি মালিকানাও নিতে চাইছে।  

বিবিসির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এই যুদ্ধের অবসান জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে। তবে এটাও সত্য ট্রাম্পের চাপ ছাড়া এই পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হতো না। তবে অগ্রগতি ট্রাম্পের বিশ্বাসের মতো  এতো দ্রুত হবে না। 

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যখন ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তখন জেলেনস্কি বলেছিলেন, পুতিনের সঙ্গে আলোচনা বেশ সহজ হবে। 

তিনি ইউক্রেনীয় সাংবাদিক দিমিত্রো গর্ডনকে বলেন, ‘আপনাকে খুব সহজভাবে কথা বলতে হবে। আপনি কী চান, আপনার শর্ত কী? আমি তাদের বলব, আমরা মাঝখানে কোথাও একমত হব।’ তবে গত দুই মাসের প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়, এই যুদ্ধের অবসান কঠিন হতে পারে।