Image description

রক্ত হিম করা ঠান্ডার মধ্যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে যখন সাইবেরিয়ার কারাগারে পাঠানো হয়, তখন রুটি ও জাউ ছাড়া নরিমান ঝেলইয়ালের খাওয়ার মতো কিছু ছিল না।

চশমা পরা, শ্মশ্রুমণ্ডিত ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের এই নেতা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি বলেন, কারাগারে তাঁকে যেসব খাবার দেওয়া হতো, সেসবের বেশির ভাগ ছিল শূকরের মাংসের তৈরি। কিন্তু ইসলামি আইনে এটি নিষিদ্ধ।

ঝেলইয়াল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমি শুধু রুটি খেতাম, তা ভালো মানের ছিল না। এ রুটি চায়ে ভিজিয়ে খেতাম।’ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের লাইন উড়িয়ে দেওয়া ও বিস্ফোরক চোরাচালানের অভিযোগে তাঁকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন বলেছে, এটা মস্কোর পরিকল্পিত ঘটনা।

ঝেলইয়াল তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

কয়েক দিন পর ঝেলইয়ালকে সাইবেরিয়ার কারাগার থেকে মিনুসিনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়। এখানে এসে তুলনামূলক কিছুটা ভালো খাবার পান তিনি।

মিনুসিনস্কের কারাগারে সকালের নাশতা ছিল স্বাদহীন, মিষ্টি ছাড়া জাউ, রাতের খাবারে থাকত মাছ, দুপুরে শূকরের মাংস।

কিন্তু রাশিয়ার কুখ্যাত কারাব্যবস্থায় হাজার হাজার মুসলিম বন্দীর জন্য খাবারই শুধু বড় সমস্যা নয়, গত শতক ধরেই সোভিয়েত ও বর্তমান রাশিয়ার কারাগারগুলো এক অন্ধকার জগৎ হয়ে রয়েছে। এগুলো পরিচালিত হচ্ছে অলিখিত সব আইনে।

প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের লাইন উড়িয়ে দেওয়া ও বিস্ফোরক চোরাচালানের অভিযোগে ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের নেতা নরিমান ঝেলইয়ালকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন বলেছে, এটা মস্কোর পরিকল্পিত ঘটনা।

এসব কারাগারে ‘ক্রাউন্ড থিভস’ বা ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাস্ট’ নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ অপরাধীদের শরীরে এখনো ট্যাটু দেখা যায়, কথাবার্তায় শোনা যায় অশ্লীল শব্দের ব্যবহার। তাঁরা নিজেরা একটি কঠোর ও নিষ্ঠুর আদেশশৃঙ্খল বজায় রেখে চলেন।

দুর্ধর্ষ এ অপরাধীরা যেসব কারাগার নিয়ন্ত্রণ করেন, সেসব ‘ব্ল্যাক প্রিজনস’ বলে পরিচিত। কারাগারগুলোতে কারা তত্ত্বাবধায়ক ও ‘ক্রাউন্ড থিভস’দের মধ্যে সংঘর্ষ, মাদক চোরাচালান, কার্ড গেম ও বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

তবে ‘রেড প্রিজনস’ কারাগারগুলোতে তত্ত্বাবধায়কেরা বেশ প্রভাবশালী। সেখানকার সাধারণ অপরাধীদের অভিযোগ, কারা তত্ত্বাবধায়কেরা এখানে এক অমানবিক পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। এর মধ্যে বন্দীদের ওপর নির্যাতন, নির্জন কারাবাস, তাঁদের অপুষ্টিতে রাখা ও ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে।

কিন্তু দুই দশক ধরে রাশিয়ার কারাগারগুলোতে দেখা যাচ্ছে আরেক শ্রেণির বাসিন্দাদের। তাঁরা হলেন মুসলিম। ‘সন্ত্রাসী কাজ’, ‘উগ্র কর্মকাণ্ড’ ও অন্যান্য অভিযোগ এনে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে তাঁদের।

রাশিয়ার ১৪ কোটি ৩০ লাখ অধিবাসীর প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম। দেশটিতে জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেলেও মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বাড়ছে।

রাশিয়ার মুফতি আলবির ক্রাগানভ গত নভেম্বরে জানান, কারাগারগুলোতেও মুসলিম বন্দীদের হার একই রকম। ২ লাখ ৬ হাজার বন্দীর মধ্যে মুসলিম ৩১ হাজার।

একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি তাঁর ধর্ম ত্যাগ করে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান মতাদর্শ গ্রহণ করলে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।
—আনা কারেতনিকোভা, রাশিয়ার ফেডারেল সার্ভিস ফর এক্সিকিউশন অব পানিশমেন্টের সাবেক বিশ্লেষক

মস্কো ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে রাশিয়ার কারাগারের কয়েদির অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। তবে ক্ষমার বিনিময়ে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণকারী বা তালিকাভুক্ত হওয়া মুসলিম বন্দীদের সংখ্যা অজানাই রয়েছে।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই বেড়ে যায় বিপদ

বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার যেসব বন্দী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁরা ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’র তালিকায় ঢুকে যান। কখনো কখনো ‘উগ্রপন্থা’র অভিযোগ এনে তাঁদের কারাদণ্ডের মেয়াদও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

রাশিয়ার সংশোধনাগারগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দেশটির প্রধান সংগঠন ‘ফেডারেল সার্ভিস ফর এক্সিকিউশন অব পানিশমেন্ট’–এর সাবেক বিশ্লেষক আনা কারেতনিকোভা। আল–জাজিরাকে তিনি বলেছেন, ‘একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি তাঁর ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান মতাদর্শ গ্রহণ করলে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।’

এই বিশ্লেষক আরও বলেন, যদি কেউ নিজ ধর্মবিশ্বাস বদলে ইসলামে দীক্ষিত হন, তবে তিনি এমন একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত হবেন, যিনি ‘উগ্রপন্থা’য় ঝুঁকছেন বলে ধরা হয়। তাঁর কারা প্রশাসনকে সাজা দেওয়া হবে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁর দিকে বিশেষ নজর দেবে। কারেতনিকোভা রাশিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়ালেও কাজ করেছেন।

দুই দশক ধরে রাশিয়ার কারাগারগুলোতে দেখা যাচ্ছে আরেক শ্রেণির বাসিন্দাদের। তাঁরা হলেন মুসলিম। ‘সন্ত্রাসী কাজ’, ‘উগ্র কর্মকাণ্ড’ ও অন্যান্য অভিযোগ এনে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে তাঁদের।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া মুসলিম অভিবাসীরা দেশটিতে ফৌজদারি বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন। কেননা, তাঁদের রুশ ভাষা, বিদ্যমান আইন ও স্থানীয় জীবনপ্রণালি সম্পর্কে জানাশোনা কম থাকে।

এই অভিবাসীদের কাউকে কাউকে জোর করে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে বলেও খবরে জানা যায়। অন্যরা দাবি করেছেন, ভিন্ন ব্যক্তিদের সংঘটিত অপরাধ নিজেদের কাঁধে চাপিয়ে রাশিয়ার পুলিশ ও কৌঁসুলিরা তাঁদের নিশানা বানাচ্ছেন।

আবদুল আজিজ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর একজন নির্মাণকর্মী। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ২০২২ সালে তাঁর ছোট ভাই আবদুল মুমিনকে ‘স্পাইস’ নামের এক সিনথেটিক মাদকে ফাঁসিয়ে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।

আরও পড়ুন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি গির্জা পরিদর্শনের সময় মস্কোয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে  মোমবাতি জ্বালান
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি গির্জা পরিদর্শনের সময় মস্কোয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালানছবি: এএফপি

এই নির্মাণকর্মীর দাবি, পুলিশ তাঁর ভাইকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে ও মারধর করে পার্কের বেঞ্চে মাদক লুকিয়ে রাখা নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালায়।

আবদুল আজিজ বলেন, একজন বিচারক আবদুল মুমিনকে সাড়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। এরপর ইউরাল মাউন্টেইনস এলাকার কারাগারে পাঠানো হয় তাঁকে। তবে তিনি ভাগ্যবান যে সেখানে অনেক ‘সবুজ’ সঙ্গী (মুসলিম বন্দী) পেয়েছেন।

সরকারের রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় আবদুল আজিজ তাঁর ডাকনাম ও অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর দাবি নিরপক্ষে সূত্রে যাচাই করতে পারেনি আল–জাজিরা।

নামাজ আদায় করা ও রোজা রাখা কঠিন

মুসলিম বন্দীদের জন্য রাশিয়ার কিছু কারাগার বসবাসের উপযুক্ত নয়। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, এসব কারাগারে রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বন্দীদের খাবার খাওয়া ও শয্যা ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এতে প্রতিদিন ফজর ও মাগরিবের নামাজ আদায় করা তাঁদের সম্ভব হয় না। পবিত্র রমজানে তাঁদের কারও কারও রোজা রাখাও কঠিন।

তবে কারাগারের কর্মীদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা চলছে। জাতিগত তাতার আজাত গাউনুতদিনভ এ প্রসঙ্গে বলেন, তাঁদের (কারাকর্মী) ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো উচিত। (কেননা) যাঁদের সঙ্গে তাঁরা কাজ করেন, সেই (মুসলিম) বন্দীদের মানসিকতা জানা দরকার। তাঁদের কারও কাছে শুধু একটি প্রার্থনাই (যেমন নামাজ) ‘চরমপন্থা’র প্রকাশ।

আরও পড়ুন

আজাত গাউনুতদিনভ কারাগারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং মুসলিম বন্দীদের অধিকার পর্যবেক্ষণকারী একটি সংগঠনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট কাভকাজস্কি উজেলকে ২০২০ সালে এ কথা বলেছিলেন তিনি।

মুসলিম বন্দীদের সঙ্গে আচরণের ধরন কখনো কখনো কারাগারবিশেষে ভিন্নও হয়ে থাকে, যেমন মিনুসিনস্ক কারাগারের তত্ত্বাবধায়কেরা কিছুটা নম্র প্রকৃতির ছিলেন। সাজার বেশির ভাগ সময় এ কারাগারেই ছিলেন ক্রিমীয় তাতার নেতা ঝেলইয়াল।

এই নেতা ও কারাগারটির অন্য মুসলিম বন্দীরা নামাজ আদায় ও পবিত্র রমজানে নিজেদের শয্যাতেই খাবার খাওয়ার সুযোগ পেতেন। এমনকি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত এবং কারাগারের গ্রন্থাগার থেকে অন্যান্য ধর্মীয় বইপুস্তক পড়ারও সুযোগ পেতেন।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, রাশিয়ার অন্যান্য কারাগারে পবিত্র কোরআন ও আরবি ভাষা নিষিদ্ধ। কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ পাওয়া গেলেও সেগুলো রুশ ভাষায় অনূদিত।

ঝেলইয়ালের তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম বন্দীরা কারাগারের অন্য বন্দীদের মতো সিগারেট, মুঠোফোন, মদ ও নেশাজাতীয় অন্যান্য মাদকদ্রব্য চোরাচালানে যুক্ত নন।

রাশিয়ার কারাগারগুলোতে ২০০০–এর দশকের প্রথম দিক থেকে বাড়তে শুরু করে মুসলিম বন্দীদের সংখ্যা। ওই সময় চেচনিয়ায় রুশ বাহিনীর সঙ্গে মুসলিম চেচেন বিদ্রোহীদের দ্বিতীয়বারের মতো লড়াই শুরু হয়।

ক্রেমলিন এই মুসলিম বিদ্রোহীদের ‘উগ্রপন্থী’ আখ্যা দিয়ে থাকে। নতুন করে লড়াই শুরুর পর নর্থ ককেশাস অঞ্চলের মুসলিম–অধ্যুষিত অন্য প্রদেশগুলো, বিশেষ করে দাগেস্তানে শুরু হয় সরকারের দমনাভিযান। গ্রেপ্তার করে কারাগারে ভরা হয় হাজার হাজার মুসলিমকে।

অনুবাদ: আবু হুরাইরাহ্‌