Image description
‘এমআইএস’ লকড

জুলাই অভ্যুত্থানে সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন জাহিদ-এ-রহিম। সে সময়টায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা। ১৯শে জুলাই শুক্রবার জুমার পর পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বেলা ৩টার দিকে ছাত্রলীগের আক্রমণ এবং পুলিশের গুলির সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন জাহিদরা। তবে মুহুর্মুহু গুলির সামনে টিকতে পারেননি জাহিদ। গুলিতে ঝাঁজরা হয় তার শরীর। রক্তে ভেজা শরীর লুটিয়ে পড়ে সড়কে। শহীদ হন জাহিদ-এ-রহিম। কিন্তু এখনো শহীদের সরকারি তালিকায় নাম আসেনি জাহিদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম-এমআইএস বন্ধ থাকায় তার নাম তালিকাভুক্ত করা যাচ্ছে না।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এই ফাউন্ডেশন থেকে শহীদ পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে আহতরা পাচ্ছেন চিকিৎসা খরচ ও সহায়তা। আহত এবং শহীদ পরিবারকে অর্থ সহায়তার দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারিভাবে তালিকা করা হয়। এই তালিকাকে প্রাথমিক তথ্যের উৎস ধরে সেবা দিয়ে থাকে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। 

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’র আওতায় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ও আহত ব্যক্তিবর্গের তালিকা প্রকাশ করার কাজ গত ১৯শে জানুয়ারি থেকে বন্ধ আছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- এমআইএস ওয়েবসাইটে নাম অন্তর্ভুক্তি না করার কারণে কোনো সহায়তাই পাচ্ছেন না তারা। এতে চিকিৎসা খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ ছাড়াও ফিল্ড ভেরিফিকেশনসহ সকল কাজ সম্পন্ন হলেও, সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ সহায়তা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেক পরিবার। তারা দ্রুত এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবি জানান।

জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের প্রমাণপত্র এবং উপযুক্ত অন্যান্য কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অথবা সিভিল সার্জন অফিস কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় গিয়ে সরকারিভাবে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে হয়।
গত বছরের ১৫ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্টের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণে যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন তাদের নাম এমআইএস তালিকাভুক্তির জন্য ‘জেলা যাচাই- বাছাই কমিটি’ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে সভাপতি এবং জেলা সিভিল সার্জনকে সদস্য সচিব করে, পুলিশ সুপার ও সামাজ সেবা কর্মকর্তা ওই কমিটির সদস্য। এ ছাড়াও ২ জন করে ছাত্র প্রতিনিধি উক্ত কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই কমিটির যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার পরেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট এমআইএস-এ নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। যা প্রায় ২ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীর শহীদ জাহিদ-এ-রহিমের বাবা মো. আব্দুর রহমান মণ্ডল মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলে জুলাই আন্দোলনে প্রথম দিকের শহীদ। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের অনেক হয়রানির শিকার হয়েছিলাম। কিন্তু এখন জুলাই আন্দোলনের আহত এবং শহীদ পরিবার সরকারি সহায়তা নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের জন্য আবেদন করছে। ইতিমধ্যে মাসিক ভাতাসহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধার জন্য গেজেটে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আমার ছেলের শহীদ হওয়ার সকল কাগজপত্র জমা দিয়েছি, এমন কি কাগজপত্র, ফিল্ড ভেরিফিকেশনও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আমি এখনো এমআইএসে নামই অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, আমি ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে বারবার গিয়েও প্রতিকার পাইনি। এমআইএস’এ নাম অন্তর্ভুক্তির কাজটা যেন দ্রুত হয় সেজন্য আমি ঢাকা জেলা সিভিল সার্জনের স্বাক্ষর নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদনও করেছি। কিন্তু সকল কাজ সম্পন্ন হলেও এমআইএস-এ তালিকাভুক্ত না করার কারণে আমি কোনো সরকারি অর্থ পাচ্ছি না।
জুলাই আন্দোলনে গত ১৮ই জুলাই চট্টগ্রাম বহদ্দার হাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ডান পায়ের হাড় সম্পূর্ণ ভেঙে যায় মো. ইসমাঈল হোসেনের। ২ দফা অপারেশন করতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে বেসরকারি মেডিকেলে। এতে প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়। কোনো সরকারি সহায়তা না পাওয়া ইসমাঈল এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তের জন্য ১১ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে শোনেন এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তকরণের কাজ বন্ধ রয়েছে। সমাধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে দেখা করেন। তাতেও হয়নি সমাধান। উপায়ান্তর না পেয়ে ১৯শে মার্চ ফের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ফাইল জমা দেন।

২ দফা অপারেশন করার পরেও সরকারের আর্থিক সহায়তা না পাওয়া ইসমাঈল ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি জুলাইয়ের প্রথম দিকেই গুলিবিদ্ধ হই। অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। কিন্তু এখনো এমআইএস-এ তালিকাভুক্ত হতে পারি নাই। বিভিন্ন জায়গায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করে আমার পায়ের গোঁড়ালি ফুলে গেছে। আমি দ্রুত প্রতিকার চাই।
ঢাকার খিলগাঁওয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন উজ্জল হোসেন। তিনি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই জুলাই ফাউন্ডেশনে আসছেন। উদ্দেশ্য এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্ত করা। মানবজমিনকে তিনি বলেন, ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন অফিসে সব কাগজ জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো এমআইএস-এ নাম আসে নাই। কারণ জানতে তাদের অফিসে গেলে বলে, আপনার মেডিকেল ডকুমেন্টসহ যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক আছে কিন্তু এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তকরণের কাজ বন্ধ আছে। কার্যক্রম শুরু হলে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ নিজেদেরই বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু অনেকে দ্বিতীয় ধাপে টাকা পাচ্ছেন। অথচ আমি এখনো প্রথম ধাপের টাকাই পাইনি। স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও এখনো এমআইএস-এ তালিকাভুক্ত না হওয়ায় মাসিক ভাতার জন্য সরকারের গেজেটে নামও আসে নাই। আমি সরকারের কাছে এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তকরণের কাজ দ্রুত শুরু করার দাবি জানাই।

প্রায় ৮ মাস ধরে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (পিজি) ভর্তি মো. সোহান। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ১৭ই মার্চ আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আহতদের ক্যাটাগরির কিছু সমস্যা, স্বাস্থ্য কার্ড এবং এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করার কাজ শুরু করার দাবি জানাই। তারা আমাদের আশ্বাস দেন এমআইএস খুলে দেয়া হবে। কিন্তু এখনো না খোলার কারণে প্রতিনিয়ত হয়রানি হচ্ছেন আহত ও শহীদ পরিবার। সরকার যেন দ্রুত এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করার কাজ শুরু করে আমরা সে দাবি জানাই।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, প্রায় ২ মাসের মতো এমআইএস-এ নতুন করে নাম অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই আহত ও শহীদ পরিবার জুলাই ফাউন্ডেশনে এসে ভিড় করে যে তারা এখনো এমআইএস-এ অন্তর্ভুক্ত হন নাই। আমরা তাদের নানাভাবে গাইড করে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এটা দ্রুতই চালু হবে। যেহেতু আহত ও শহীদ পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেয়ার জন্য আমরা এমআইএসকে তথ্যের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ধরি, সুতরাং এমআইএস-এ নাম না থাকলে নতুন করে যারা আসছে তাদের আমরা কোনো সহায়তাই দিতে পারি না। সরকারকে এটা বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত এমআইএস চালু করার দাবি জানান তিনি।

ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানবিদ মো. রকিবুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রতিদিন এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ২০ থেকে ২৫ জন আসছে। সারা দেশে প্রায় ২০০০ জনের মতো আহত লোক নতুন করে এমআইএস-এ তালিকাভুক্তির অপেক্ষায়। এ ছাড়াও ৩ জন শহীদ কেস ভেরিফিকেশনসহ সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন। কিন্তু এমআইএস-এ অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি না। আমরা এমআইএস-এ তথ্য এন্ট্রি করি। কিন্তু এটা মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তারা যদি খুলে দেন আমরা দ্রুত কাজ শুরু করবো।

ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ঢাকা জেলায় এখনো ১২৬টা ফাইল ভেরিফাইড আছে। এগুলো এখনো এমআইএস-এ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। গত ১৬ই মার্চ জেলা প্রশাসকসহ আমরা মিটিং করেছি। সেখানে এমআইএস’র বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এটা মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়ে আসলে আমরা কাজ শুরু করবো।

সারা দেশে এখনো প্রায় ৩০ শতাংশ আহত ও শহীদের নাম এমআইএস-এ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ ছাড়াও ঢাকা জেলায় ২,২২০ জন ভেরিফাইড আহত স্বাস্থ্য কার্ডের আওতায় এসেছেন। এরমধ্যে ১৫৬৪ জন ঢাকায় রয়েছেন। বাকিরা স্থায়ী ঠিকানায় চলে গেছেন। এই কার্ডগুলোও দেয়া শুরু হবে। এখন আমরা ২০০ কার্ড ইস্যু করলেও পর্যায়ক্রমে বাকিদের স্বাস্থ্য কার্ড দেয়া হবে। এ কার্ডের আওতায় জুলাই আন্দোলনে আহতরা সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।

গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা মো. মশিউর রহমান (যুগ্ম সচিব) মানবজমিনকে বলেন, যেহেতু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস সার্ভারে নতুন করে নাম এন্ট্রি বন্ধ আছে, আমরা এ বিষয়ে কিছু করতে পারবো না। হাসপাতাল থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে এমআইএস সার্ভারে নাম অন্তর্ভুক্ত হলেই কেবল ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করাসহ যাবতীয় সুবিধা পাবে। কিন্তু এটা বন্ধ থাকায় আমাদের কাছে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই।