
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত দুই হাজারের বেশি নথি প্রকাশ করা হয়েছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত নথির মাধ্যমে সাবেক প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত ৬০ বছরের জট খুলতে পারে।
যদিও কেনেডির হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার মতো খুব কম তথ্যই রয়েছে। নথিগুলো স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কৌশল সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়। এ ছাড়া, এগুলো কেনেডির হত্যাকারী সম্পর্কে কিছু গোয়েন্দা প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।
কীভাবে জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয়েছিল?
১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর টেক্সাসের ডালাসে জন এফ কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করেন লি হার্ভে অসওয়াল্ড নামে ২৪ বছর বয়সী একজন সাবেক মার্কিন মেরিন সেনা। টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরির ষষ্ঠ তলা থেকে গুলি চালিয়েছিলেন এই কর্মকর্তা। তবে হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পরই তাকে কারাগারে স্থানান্তরের সময় গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন নাইটক্লাব মালিক জ্যাক রুবি।
ওয়ারেন কমিশনের তদন্ত ও নতুন তথ্য: কেনেডির হত্যার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন ‘ওয়ারেন কমিশন’ গঠন করেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেনের নেতৃত্বে এই কমিশন ১৯৬৪ সালে জানায়, অসওয়াল্ড একাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। এতে অন্য কেউ জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই বলেও জানায় কমিশন।
নতুন নথিগুলো কি ওয়ারেন কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে?
দীর্ঘদিন ধরে অনেক আমেরিকান এই সরকারি ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করেননি। ২০২৩ সালে গ্যালাপের এক জরিপে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ আমেরিকান ওয়ারেন কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তবে নতুন প্রকাশিত নথিগুলো এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোনো নতুন তথ্য প্রকাশ করেনি। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মার্ক সেলভারস্টোন বলেন, ‘অসওয়াল্ড একাই কেনেডিকে হত্যা করেছে দাবি করা কমিশনের ধারণাকে পরিবর্তন করে এমন কিছু আমি নথিতে দেখিনি। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডটি কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল না। নথির বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডের মূল ঘটনাবলীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।’
কেনেডির হত্যাকারী অসওয়াল্ড সম্পর্কে নতুন কি জানা গেল?
নথিগুলো নিশ্চিত করেছে হত্যার আগে অসওয়াল্ড মেক্সিকো সিটিতে সোভিয়েত ও কিউবান দূতাবাস পরিদর্শন করেছিলেন। একটি নথিতে অসওয়াল্ডের সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকার সময়কার কিছু বিশদ তথ্য রয়েছে। তিনি ১৯৫৯ সালে সেখানে চলে যান, মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন এবং ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন।
নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কমিটি বা কেজিবির একজন এজেন্ট নিকোনভ, অসওয়াল্ড সম্পর্কে ফাইল পর্যালোচনা করেছিলেন। যদিও নথি পর্যালোচনায় জানা যায়, তিনি কখনও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট ছিলেন না।
নথিগুলো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএয়ের অন্যান্য অপারেশন সম্পর্কে যে বার্তা দেয়: প্রেসিডেন্ট হত্যাকাণ্ডের বাইরে নথিগুলো মার্কিন গোয়েন্দা এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে বিদেশি নীতির প্রচেষ্টা সম্পর্কে আরও বিস্তৃত তথ্য প্রকাশ করেছে। যার মধ্যে 'অপারেশন মঙ্গুজ' নামে একটি শীর্ষ গোপন ক্যাম্পেইন ছিল। ক্যাম্পেইনটি কিউবার কমিউনিস্ট সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল।
আরেকটি নথিতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্থিতিশীল সেই পরিস্থিতির সময় সিআইএ ১৫০০ এজেন্টকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা হিসেবে দেশের বাইরে মোতায়েন করেছিল। এরমধ্যে ১২৮ জন প্যারিসের মার্কিন দূতাবাসে ছিল। এ বিষয়ে আর্থার শ্লেসিঞ্জার জুনিয়র নামে কেনেডির একজন প্রধান সহযোগী সতর্ক করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, এই অনুশীলনটি পররাষ্ট্র নীতিতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভূমিকাকে দুর্বল করতে পারে।
নথিতে বিদেশি সরকারগুলোকে উৎখাত করার প্রচেষ্টায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জড়িত থাকার বিষয়েও বিশদ বর্ণনা রয়েছে। যদিও এই বিবরণগুলো যেসব ঘটনার বিষয়ে বলা হয়েছে তার অধিকাংশই আগে থেকেই মানুষ জানত। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৬৩ সালের সিআইএ পরিচালকের কার্যালয় এবং কিউবায় অপারেটিভদের মধ্যে যোগাযোগের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সংস্থাটি ১৯৫৯ সালে ক্ষমতায় আসা ফিদেল কাস্ত্রো সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
ভিলানোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড ব্যারেট এ বিষয়ে আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমরা কিউবায় কাস্ত্রোর মতো অন্যান্য দেশের নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছু দেখছি।’
সিআইএ সম্পর্কিত আরেকটি নথি থেকে জানা যায়, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ট্রুজিলোর সরকারকে অপসারণ করার লক্ষ্যে ইফোরডিইইডি নামক গোপন পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬০ সালে ডোমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল এবং ১৯৬১ সালের মে মাসে ট্রুজিলোকে হত্যা করা হয়েছিল। গাড়িতে করে সান ক্রিস্টোবালের দিকে রওয়ানা দিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় একটি হাইওয়েতে বন্দুকধারীদের গুলিতে তিনি নিহত হন।
কি পরিমাণ নথি প্রকাশ হয়েছে এবং নথিগুলো প্রকাশের তাৎপর্য কি?
ন্যাশনাল আর্কাইভস অনুসারে, নতুন নথিগুলো প্রকাশের আগে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই ১৯৯২ জে এফ রেকর্ডস আইনের অধীনে পর্যালোচনা করা প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার নথির অধিকাংশই প্রকাশ করেছে।
এসব প্রকাশের অন্যতম কারণ হলো ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জন এফ কেনেডি, তার ভাই রবার্ট এফ কেনেডি এবং নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যার সব নথি প্রকাশের নির্দেশনা ছিল। এই নির্দেশনার পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই প্রায় ২,৪০০ নতুন নথি আবিষ্কার করে এবং জাতীয় আর্কাইভে হস্তান্তর করে।
জেএফকে হত্যার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আসলে কি?
কমিশনের মাধ্যমে কেনেডির হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের পর অনেকেই তা বিশ্বাস করেননি। এরই প্রেক্ষিতে বছরের পর বছর ধরে অনেকেই নানাভাবে হত্যাকাণ্ডটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু প্রকাশিত নথিগুলোতে কয়েক দশক ধরে চলা এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভিত্তি পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালের গ্যালাপ জরিপে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেয়াদের ২০ শতাংশ বিশ্বাস করেছিলেন কেনেডিকে হত্যা করার জন্য অসওয়াল্ড মার্কিন সরকারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এবং ১৬ শতাংশ মনে করেন তিনি সিআইএর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। নথির বর্ণনা অনুযায়ী এই ধারণাগুলোরও কোনো ভিত্তি নেই।
ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাখ্যাগুলোতে আরও দাবি করা হয়েছিল কেনেডি বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। বলা হয়, তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জনসন ক্ষমতা পেতে এমনটি করে থাকতে পারেন। এই বিষয়গুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করেছিল এবং কিছুটা প্রমাণিত হয়েছিল।
এমনকি কেনেডির মৃত্যু সম্পর্কে ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে উসকে দিয়েছেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালে প্রচারাভিযানের সময়, তিনি ন্যাশনাল এনকোয়ারারের একটি গল্প উল্লেখ করে দাবি করেছিলেন, তৎকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী টেড ক্রুজের বাবা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। যদিও ২০২৪ সালে, প্রকাশনার প্রাক্তন প্রকাশক ডেভিড পেকার গল্পটি বানোয়াট বলে জানিয়েছিলেন।
এই নথি প্রকাশের উদ্দেশ্য স্বচ্ছতার জন্য নাকি মিডিয়া কাভারেজের জন্য: সর্বশেষ প্রকাশিত নথি পূর্ববর্তী প্রকাশিত নথির তুলনায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যেই এমনটি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। অনেক বিশেষজ্ঞও এই নথিগুলো প্রকাশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে, কেনেডির নাতি জ্যাক শ্লোসবার্গ এক্স-এ বলেছিলে, নথি প্রকাশের ব্যাপারে কেনেডি পরিবারকে কোনো আগাম ইঙ্গিত দেয়া হয়নি।