
ইরান, মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিশাল। ইরান পৃথিবীর অন্যতম বড় তেল উৎপাদক দেশ। এর ভূ-অবস্থান শক্তিশালী বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, আঞ্চলিক সংঘাত ও আন্তর্জাতিক চাপের মাঝে ইরানকে তার অবস্থান শক্ত করতে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ইরানের ভূরাজনীতি ও এর গুরুত্ব, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিবিধি নিয়ে সাজানো হয়েছে এ প্রতিবেদন।
ইরানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব
ইরান যে ভূ-অবস্থানে অবস্থিত, তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ইরান পৃথিবীর বৃহৎ তেল ও গ্যাস রিজার্ভের অধিকারী। এর মাধ্যমে এটি বিশ্বের শক্তিশালী দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
ইরানের সীমানা রয়েছে তুরস্ক, পাকিস্তান, আর্মেনিয়া, আফগানিস্তানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে। এ ছাড়া ইরান শিয়া মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত, যা তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবকে আরো শক্তিশালী করেছে। এর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক প্রভাব বহু শতাব্দী ধরে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। বর্তমানে আধুনিক ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইরান।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং রাশিয়াও ইরানকে তাদের স্বার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে গণ্য করে। তাই ইরান আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ‘ম্যাক্সিমাম প্রেসার’ নীতি
২০১৮ সালে, ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘ম্যাক্সিমাম প্রেসার’ নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানকে তার প্রধান রপ্তানি খাত—তেল ও গ্যাস—বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে বাধা দেয়, যার ফলে ইরান অত্যন্ত অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে বাধ্য হয়।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শুধু ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে চায় না, বরং তার আঞ্চলিক প্রভাবকে কমানোর উদ্দেশ্যও রয়েছে। ইরান যাতে তার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার না করতে পারে এবং অন্য দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করতে না পারে, সেজন্য এই নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করা হয়েছে। ইরানকে একভাবে কোণঠাসা করে রাখার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
তবে ইরান এ চাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পুনরায় প্রবেশ করার জন্য একাধিক কৌশল গ্রহণ করেছে। চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার মাধ্যমে ইরান নিজের অবস্থান শক্ত করতে চাচ্ছে।
ইরান তার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ কিছু কৌশল নিয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনের সাথে ইরান সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। ২০১৯ সালে ইরান ও চীন একটি দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ইরান থেকে তেল ও গ্যাসের বড় একটি অংশ আমদানি করে চীন। এই চুক্তি ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে, যদিও তা পুরোপুরি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে মুক্ত পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে ইরান অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য নানা প্রকল্প শুরু করেছে। রেলপথ নির্মাণ, বন্দর নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে একযোগে কাজ করছে ইরান ও রাশিয়া। ইরানকে প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে দেখে রাশিয়া।
পাকিস্তান-রাশিয়ার রেলপথ নির্মাণ
পাকিস্তান ও রাশিয়া দুই দেশই নতুন একটি রেলপথ চালু করতে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াতে এ পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই রেলপথ ইরান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তান হয়ে যাবে, যা রাশিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যে পণ্য পরিবহনে সহায়তা করবে। বিশেষ করে রেলপথটি ইরানকে তার অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তান ও রাশিয়া এখন ইরানকে তাদের বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছে, তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তাদের এই সম্পর্কের মাত্রা কিছুটা সীমিত করতে পারে। তাই ইরানকে আরো কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়। যদিও আফগানিস্তানকে ট্রানজিট রাষ্ট্র হিসেবে ব্যবহার করে আরও কার্যকরভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত, কিন্তু পাকিস্তান-তালেবান উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে এটি সম্ভব নয়।
আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ইরান
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূরাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরব, ইসরায়েল ও অন্যান্য শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের মধ্যে ইরানের অবস্থান। ইরান নিজেকে একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তবে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ, এবং ইরানের সঙ্গে তাদের বহু বছরের রাজনৈতিক লড়াই রয়েছে।
ইরান ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননের বিভিন্ন সংঘর্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে এবং এই অঞ্চলের শিয়া মিলিশিয়া ও সহযোগীদের মাধ্যমে তার প্রভাব বিস্তার করছে। এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা জটিলতাকে আরও গভীর করছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হচ্ছে।
ভবিষ্যতে ইরান
ইরানের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকট এর প্রধান সমস্যা। তবে ইরান তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা ইরানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
এ ছাড়া ইরান যদি তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হয় এবং আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তবে এটি ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী একটি ভূরাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ইরানকে আরও বেশি কৌশলগত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার বন্ধু দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে হবে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স,