
“কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ”- বাংলা ভাষার অতি প্রচলিত এই প্রবাদটির অর্থ এই ভাষাভাষী মোটামুটি সবাই জানে, যার অর্থ- এক পক্ষ সমস্যায় পড়লে অন্য পক্ষের সুবিধা হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কির অপদস্ত হওয়ার পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের স্বার্থ ব্যাখ্যায় এই প্রবাদটিই হয়ে উঠেছে অতি প্রাসঙ্গিক।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে নজিরবিহীন বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান ট্রাম্প ও জেলেনস্কি। ওই ঘটনার পর রুশ মিডিয়াগুলোকে নানাভাবে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
অবশ্য দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর ইউক্রেন নিয়ে নিজের যে অবস্থান গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন ট্রাম্প, তাতে এরকম কিছু যে ঘটতে চলেছে- তা অনেকটাই ছিল অনুমেয়।
জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের এই বিবাদ রাশিয়ার জন্য আর্শীবাদ হয়ে এসেছে। একদিকে, এতদিন ধরে যে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ও সামরিক সহায়তায় ইউক্রেন দেশটির আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি পাল্টা হামলা করে আসছিল, ইউক্রেনের মাথা ওপর থেকে সহায়তার সেই হাত সরে গিয়েছে।
অন্যদিকে, খনিজ চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বাগিয়ে নিতে কিয়েভের যে আশার প্রদীপ নিভু নিভু করে হলেও জ্বলছিল, তাও নিভে গেছে দপ করে। তাই রাশিয়া এবং দেশটির গণমাধ্যগুলো ট্রাম্পের প্রশংসায় হয়ে উঠেছে পঞ্চমুখ, ট্রাম্পের মাধ্যমে তারাই যেন এক হাত নিয়েছে জেলেনস্কিকে!
ট্রাম্প–জেলেনস্কির বাগ্বিতণ্ডার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই উন্মাদের (জেলেনস্কি) মুখের ওপর একদম সত্যি কথা বলেছেন যে, কিয়েভের শাসনকাঠামো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে খেলছে।”
ট্রাম্পের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, “তিনি (ট্রাম্প) ঠিক কাজই করেছেন। তবে এটিই যথেষ্ট নয়, কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দেওয়াও বন্ধ করতে হবে।”
ইউক্রেনের মিত্র দেশ পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেন সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করায় বেশ খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল মস্কো।
ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ট্রাম্প ইউক্রেনে ইউরোপের শান্তিরক্ষীদের সহায়তা দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন; এতে চিন্তা বাড়ছিল মস্কোতে। তবে শুক্রবারের ওভাল অফিসে যে কাণ্ড হলো, তাতে নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ক্রেমলিন।
ওভাল অফিসের ঘটনার পর রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা টেলিগ্রাম পোস্টে লেখেন, “ট্রাম্প ও ভ্যান্স যেভাবে এই জঘন্য ব্যক্তিকে (জেলেনস্কি) আঘাত করা থেকে নিজেদের বিরত রাখলেন, সেটি সংযম প্রদর্শনের এক অলৌকিক ঘটনা।”
এ ঘটনায় ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে কিছু না বললেও রুশ প্রেসিডেন্ট যে খুশি হয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ এক সূত্র বলেছে, “নিঃসন্দেহে প্রেসিডেন্ট এই তামাশা উপভোগ করেছেন। তিনি এখন ইউক্রেন থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন।”
এছাড়া ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিন ফোনালাপ করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ওই সূত্র। ফোনালাপে (ইউক্রেনের ক্ষমতায়) জেলেনস্কির বিকল্প নিয়ে কথা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
সম্প্রতি জেলেনস্কির ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার বৈধতা নিয়ে একই সুরে কথা বলতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে। মূলত জেলেনস্কিকে সরিয়ে রুশ-সমর্থিত কাউকে ইউক্রেনের মসনদে বসানোর বাসনা পুতিনের নতুন নয়। বেশ আগে থেকেই তিনি এই ইচ্ছার কথা জানিয়ে এসেছেন। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রই এই ধারণার অন্যতম প্রধান বিরোধী হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও আশ্চর্যজনকভাবে এবার পুতিনের সুরে সুর মেলাতে দেখা গেছে ট্রাম্পকে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে শিগগিরই আলোচনার টেবিলে বসতে জেলেনস্কিকে হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। সে সময় জেলেনস্কিকে “অনির্বাচিত স্বৈরশাসক” আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “শান্তি নিশ্চিত করতে হয় তাকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, অথবা তার দেশকে হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে।”
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেলেনস্কির বৈধতা নিয়ে ট্রাম্প আগেই যেহেতু প্রশ্ন তুলেছেন, তাই শুক্রবারের ঘটনা পুতিনকে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে অব্যশই সুবিধা দেবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে রাশিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য অ্যালেক্সি পুশকভ এক টেলিগ্রাম পোস্টে বলেছেন, হোয়াইট হাউসও এখন জেলেনস্কিকে সরিয়ে ইউক্রেনের ক্ষমতায় নতুন কাউকে বসানো নিয়ে আরও গুরুত্ব দিয়ে চিন্তাভাবনা করবে বলে তার বিশ্বাস।
তবে ট্রাম্প-জেলেনস্কি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কেই চূড়ান্ত বিজয় হিসেবে না দেখে রাশিয়াকে কৌশলের সঙ্গে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ফিওদর লুকানভ। ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত স্বভাবের কারণে তিনি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।
অন্যদিকে, হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভর্ৎসনার শিকার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে রাজকীয় অভ্যর্থনা পেয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্র সহায়তার হাত সরিয়ে নিলেও ইউক্রেনকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার।
এর আগে, জেলেনস্কির প্রশংসা করে এক এক্স পোস্টে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লেয়েন লিখেছিলেন, “আপনার এই ব্যক্তিত্ব ইউক্রেনের জনগণের সাহসিকতাকে সম্মানিত করেছে।”
জেলেনস্কিকে সাহসী ও নির্ভীক থাকতে অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি বলেন, “আপনি একা নন, আমরা রয়েছি আপনার পাশে।” তবে শুধু আশ্বাস নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হওয়ায় এখন ইউরোপ কিয়েভকে ঠিক কতটা সহায়তা দেবে কিংবা ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে কি-না, এর ওপর নির্ভর করছে ইউক্রেনের ভাগ্য।
অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপের হাত ধরে ইউক্রেন জয় পাবে না কি যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেন জয় করবে রাশিয়া—তা-ই এখন দেখার অপেক্ষা।