Image description
 

একটা নির্বাচন। নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ। আর তারপরেই ১৮০ ডিগ্রির ডিগবাজি! রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শরীরী ভাষা’কে ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করছে আন্তর্জাতিক মহল। ইতোমধ্যেই তার প্রবল সমালোচনায় মুখর হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশ। আর পরিস্থিতি দেখেশুনে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে মস্কো।চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি নিজের সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে একটি লম্বা পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি জেলেনস্কিকে ‘স্বৈরাচারী একনায়ক’ এবং ‘মধ্যমানের কৌতুক অভিনেতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার ওই পোস্টের পরেই ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে জুড়ে শুরু হয় ব্যাপক শোরগোল।সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘নির্বাচন না করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে রয়েছেন স্বৈরাচারী একনায়ক জেলেনস্কি। তার এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ  নেওয়া উচিত। তা না হলে হয়তো একটা সময়ে নিজের দেশটাও খুইয়ে বসবেন তিনি’উল্লেখ্য, গত বছর প্রেসিডেন্ট হিসাবে শেষ হয় জেলেনস্কির কার্যকালের মেয়াদ। কিন্তু টানা প্রায় তিন বছর ধরে যুদ্ধ চলায় নির্বাচন করা যাচ্ছে না বলে যুক্তি দিয়েছেন তিনি।

 

মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন তীক্ষ্ম বাক্যবাণের জবাব অবশ্য চাঁচাছোলা ভাষায় দেননি জেলেনস্কি। ২০ ফেব্রুয়ারি পালটা বিবৃতি দিয়ে বলেন, রাশিয়ার প্রচার করা ভুল তথ্যের শিকার হচ্ছে আমেরিকা’। তবে ট্রাম্পের পোস্টে যে তিনি রীতিমতো হতবাক, তা জানাতে ভোলেননি সাবেক জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা তথা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা ভাব দেখিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেন সৈনিকদের অনেকেই হেলমেটে আমেরিকার পতাকা সাঁটিয়ে যুদ্ধ লড়ছিলেন। ট্রাম্পের পোস্ট ছড়িয়ে পড়তেই সেগুলো ছিঁড়েছেন তারা। সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েও দেওয়া হয়েছে।মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে শুধুমাত্র ‘স্বৈরাচারী একনায়ক’ এবং ‘মধ্যমানের কৌতুক অভিনেতা’ বলেই যে খোঁচা দিয়েছেন, এমনটা নয়। ঘুরিয়ে তার বিরুদ্ধে এনেছেন দুর্নীতির অভিযোগও। ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প লিখেছেন, ‘এই যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনকে ৩৫ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে ওয়াশিংটন। এর অর্ধেকের কোনো হিসাবই দিতে পারছেন না জেলেনস্কি। এমন একটা লড়াইয়ে টাকা দেওয়া হয়েছে, যেখানে কিয়েভ কখনোই জিতবে না’২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযানের (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ওই দিন থেকে পূর্ব ইউরোপে শুরু হয় যুদ্ধ। কিন্তু, এই ঘটনাও মানতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। জেলেনস্কির বাহিনী প্রথমে রাশিয়া আক্রমণ করে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।ট্রাম্পের করা ওই পোস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ৮০ লাখ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টটির মন্তব্য বাক্সে মার্কিনিদের একাংশ প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করে নিজেদের মতামত লিখেছেন। 

 

সংবাদ সংস্থা সিএনএন জানিয়েছে, যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকে দেওয়া অর্থে চাঙ্গা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সবগুলো সংস্থা। কারণ তাদের থেকে গত তিন বছর ধরে লাগাতার হাতিয়ার কিনেছে ইউক্রেন। ফলে ট্রাম্পের দাবিকে অযৌক্তিক বলে দাবি করেছে ওই গণমাধ্যম।সম্প্রতি জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর বৈঠকে যোগ দেয় আমেরিকা। সেখানে রাশিয়াকে ‘আগ্রাসী দেশ’ হিসাবে তকমা দেওয়া হলেও, এই ইস্যুতে নিজেদের দূরে রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর এই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেয়নি ওয়াশিংটন। বিষয়টি নিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল মাক্রোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার। ইউরোপের এই দুই রাজনৈতিক নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন কতটা গলাতে পারবেন, তা নিয়ে অবশ্য সন্দিহান আন্তর্জাতিক মহল।এ বছরের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে তৎপরতা দেখাচ্ছেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই সৌদি আরবে রুশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক সেরেছেন তার প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেখানে জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুব দ্রুত রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন ট্রাম্প।বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ট্রাম্পের নিশানায় জেলেনস্কি চলে আসার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনকে বিপুল অর্থ দেওয়ার বিনিময়ে সেখানকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খনির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। জেলেনস্কি এতে রাজি না হওয়ায় প্রথম থেকেই তার উপর চটেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।দ্বিতীয়ত, পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের শর্ত মেনেই হবে, তা নিশ্চিতভাবেই জানেন ট্রাম্প। কিন্তু সেটা করতে গেলে মসনদ থেকে সরাতে হবে জেলেনস্কিকে। আর সে জন্যেই ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকে কড়া বাক্যবাণে বিঁধেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। 

 

অন্যদিকে তার ওই পোস্টকে ‘প্রত্যাশার চেয়ে বেশি’ বলে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে মস্কো।রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট তথা দেশটির নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদ এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, তিন মাস আগেও কেউ যদি এসে বলত, এগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথা, তাহলে হয়ত জোরে হেসে ফেলতাম। তবে ট্রাম্প সত্যিটাই লিখেছেন, যেটা মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট হচ্ছে।অন্যদিকে ৪৭ বছর বয়সি ইউক্রেনীয় আইনজীবী ওলেনা টোকোভেনকো এ ব্যাপারে সামাজিক মাধ্যমে করা পোস্টে লিখেছেন, ‘ট্রাম্প যা শুরু করেছেন, তাতে হয়ত এবার এখানকার নির্বাচনেও প্রার্থী দিয়ে বসবেন। এখন তো মনে হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নয়, যুদ্ধবাজ পুতিনকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে, আমাদের কোনটা করা উচিত এবং কোনটা নয়। এতে অন্তত একটা মধ্যস্থতাকারীর সংখ্যা কমবে। কারণ, ট্রাম্প রুশ নীতিই ঘাড়ে করে বয়ে আনছেন।’রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির শর্তগুলো নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন ওয়াশিংটনের ‘কর্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর গবেষক অ্যান্ড্রু ওয়েইস। তার কথায়, ‘সংঘর্ষবিরতিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুটো দেশের আলাদা আলাদা লক্ষ্য রয়েছে। হারানো যাবতীয় জমি ফিরে পেতে চাইছে ইউক্রেন। কিন্তু সেটা কোনো মতেই দিতে রাজি নয় মস্কো।’অ্যান্ড্রু জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার দাবিগুলো তুলনামূলকভাবে কঠিন। প্রথমত, ইউক্রেনের যে জমি মস্কো দখল করেছে, তার রুশ ভূখণ্ড হিসাবে মান্যতা পেতে চাইছেন পুতিন। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের ফৌজকে সীমিত রাখার কথাও বলেছে ক্রেমলিন। তৃতীয়ত, পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিকে কখনোই মার্কিন শক্তিজোট ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া যাবে না।

 

২০১৪ সালে প্রথমবার কিয়েভের ওপর আগ্রাসী হন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ওই বছর সেনা পাঠিয়ে ইউক্রেনের থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেন তিনি। ২০২২ সালে দুই দেশের মধ্যে ফের যুদ্ধ বাধলে মস্কোর বিরুদ্ধে অন্তত ৫০টি দেশটিকে সংঘবদ্ধ করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপরই জেলেনস্কিকে হাতিয়ার এবং ডলার সরবরাহ করতে শুরু করে ওয়াশিংটন।রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন কিয়েভ সফর করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। শুধু তা-ই নয়, তার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ওয়াশিংটনে যান জেলেনস্কি। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এ ভাষণও দিয়েছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ওই সময়ে শান্তির জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার দাবিও জোরালো হয়েছিল।সেই জায়গা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করায় কিয়েভের বিপদ বাড়ল বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। কারণ, মার্কিন হাতিয়ার ছাড়া ইউক্রেন কতক্ষণ রুশ সাঁড়াশি আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দিহান দুনিয়ার তাবড় সেনা অফিসারেরা।আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখোমুখি হলেই পুতিন তার দেশের উপরে থাকা যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে পারেন। যুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই সেই সব নিষেধাজ্ঞা মস্কোর ওপর চাপিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প তা প্রত্যাহার করলে ইউক্রেনের পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।