জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা উদীচীর কক্ষে নিয়মিত গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় জবি প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ইমরান হুসাইন, রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। গত কয়েক মাস ধরে সংগঠনের কক্ষে চলমান কথিত মাদক সেবনের অসংখ্য অভিযোগ বারবার প্রক্টরিয়াল বডির কাছে পৌঁছালেও পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
রবিবার (১৬ নভেম্বর) প্রক্টর বরাবর দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়; বরং বহু দিন ধরেই উদীচীর কক্ষকে কয়েকজন সদস্য ও বহিরাগতরা নিয়মিত মাদক সেবনের স্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠলেও বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত ছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে কক্ষটিকে একটি অপরাধপ্রবণ জায়গা হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ নভেম্বর (শুক্রবার) রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশ ভবনের চতুর্থ তলায় প্রেসক্লাবের নিয়মিত কার্যক্রম চলার সময় হঠাৎ তীব্র গাঁজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিকরা বিষয়টি যাচাই করতে নম্রভাবে পাশের উদীচী জবি শাখার কক্ষে গেলে দেখতে পান জানালার পাশে সদ্য ব্যবহৃত গাজার ছাই পড়ে আছে এবং ওই স্থান থেকেই তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। ঘটনার সময় কক্ষে উপস্থিত থাকলেও নাট্যকলা বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী শোভন প্রথমে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। এরপর একই ব্যাচের মনন মোস্তাকিন কক্ষ থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের ওপর উত্তেজিত আচরণ দেখাতে থাকেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, মনন মোস্তাকিন প্রকাশ্যেই গাঁজা সেবনের কথা স্বীকার করে বলেন, “আমি গাজা খাই, ভিসি ভবনের সামনে চল। আমি মাইকিং করে বলবো আমি গাঁজা খাই—যা করার কর।” তার এই আচরণকে সাংবাদিকরা ভয়ভীতি, উস্কানি এবং প্রত্যক্ষ অপমান হিসেবে দেখেছেন। এরপর সৌমিক বোস, রুদ্ধসহ আরও কয়েকজন উদীচী সদস্য এবং দুই নারী সদস্যও সাংবাদিকদের উদ্দেশে অশোভন অঙ্গভঙ্গি ও হুমকি প্রদান করেন। এ সময় উপস্থিত প্রেসক্লাবের সিনিয়র সাংবাদিকরা পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলে তাঁদের সঙ্গেও অশোভন আচরণ করা হয়।
পরে সাংবাদিকরা বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে অবহিত করলে তিনি সহকারী প্রক্টরকে ঘটনাস্থলে পাঠান। সহকারী প্রক্টর উপস্থিত হলে উদীচীর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আমরিন জাহান অমি স্বীকার করেন যে সংগঠনের কক্ষে দীর্ঘদিন ধরে মাদকসেবন ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে আসছে এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে এসব ঘটনা একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি আরও বলেন, এসব কর্মকাণ্ডে সংগঠনের কিছু সদস্য ছাড়াও কয়েকজন বহিরাগত নিয়মিতভাবে জড়িত। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অতীতেও উদীচীর কক্ষে সংগঠনের সদস্যদের হাতে-নাতে আটক করার ঘটনা প্রক্টরিয়াল বডির রেকর্ডে রয়েছে—যা কক্ষটিকে দীর্ঘদিন ধরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, ১৫ নভেম্বর (শনিবার) একাধিক সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিকেল ৩টার দিকে টিএসসির পাশে চায়ের দোকানে প্রেসক্লাবের সভাপতি মেহেদী হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক ইউছুব ওসমান অবস্থানকালে বামধারার সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীরা তাদের ঘিরে ফেলেন। অভিযোগ অনুযায়ী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জবি শাখার সভাপতি ইভান তাহসিবের নেতৃত্বে ১৫–২০ জন নেতাকর্মী সাংবাদিকদের চারদিক থেকে ঘিরে মব তৈরির চেষ্টা করেন। এ সময় সংবাদ কেন প্রকাশ করা হয়েছে জানতে উচ্চবাচ্য, ভয়ভীতি প্রদর্শন, উস্কানিমূলক মন্তব্য ও “দেখে নেওয়া হবে” ধরনের সরাসরি হুমকি দেওয়া হয়। অভিযোগে বলা হয়েছে, মনন মোস্তাকিন একজন সাংবাদিককে কয়েকবার উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনি একজন খারাপ মানুষ, ভালো মানুষ হন”—যা স্পষ্টভাবে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা। সাংবাদিকরা শান্ত থেকে পেশাগত ব্যাখ্যা দিলেও নেতাকর্মীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। অভিযোগপত্রে এটিকে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা, শারীরিক নিরাপত্তা এবং মতপ্রকাশের অধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, উদীচী কক্ষে দীর্ঘদিন ধরে চলমান মাদক সেবন ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আড়াল করতেই সাংবাদিকদের ভয়ভীতি, হুমকি এবং সংগঠিতভাবে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি, আইনি কাঠামো এবং সুশৃঙ্খল শিক্ষার পরিবেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সাংবাদিকদের প্রতি সহমর্মিতা ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।জবি প্রেসক্লাব অভিযোগপত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—১৪ নভেম্বর সাংবাদিকদের ওপর হুমকি ও অশোভন আচরণে জড়িত মনন মোস্তাকিন, সৌমিক বোস, রুদ্র এবং নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাস্তিমূলক বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ; ১৫ নভেম্বর টিএসসিতে সাংবাদিকদের ঘিরে ধরার ঘটনায় ইভান তাহসিবসহ ১৫–২০ জনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা; উদীচীর কক্ষে চলমান মাদকসেবন ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত; তদন্তকালীন সময় কক্ষটি সিলগালা; সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থায়ী নির্দেশনা প্রদান; এবং অবকাশ ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে দ্রুত সিসিটিভি স্থাপন।
এদিকে, গাঁজা সেবন ও সাংবাদিক হেনস্তার সংবাদ প্রকাশের জেরে উদীচীর পক্ষ থেকে প্রক্টর অফিসে একটি পাল্টা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, “আমরা দুই পক্ষ থেকেই অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”