
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গদি টিকিয়ে রাখতে গত বছরের ৪ আগস্ট গোপন সভা হয়েছিল। সেই বৈঠকে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের অনেকেই এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে বহাল আছেন।
জুলাই আন্দোলন দমন, এক দফা দাবি প্রত্যাখ্যান ও অভ্যুত্থানপন্থি ছাত্র-শিক্ষকদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এই শিক্ষকরা ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এমনকি পদোন্নতি নেওয়ারও চেষ্টা করছেন। এতে চরম ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভ্যুত্থানপন্থি শিক্ষকরা।
আওয়ামীপন্থি ও ফ্যাসিস্টের দোসর শিক্ষকদের অপসারণ দাবিতে শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় আন্দোলন করলেও তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এক পর্যায়ে বিক্ষোভের মুখে পদ হারাতে হয়েছে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে। এরপর গত ১৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তৌফিক আলম। নিয়োগের চার
মাস পার হলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাকে। বরং এই শিক্ষকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে শলাপরামর্শ করার অভিযোগ উঠেছে। মাস পার হলেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাকে। বরং এই শিক্ষকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে শলাপরামর্শ করার অভিযোগ উঠেছে।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল আমার দেশ-এর মাল্টিমিডিয়ায় শেখ হাসিনার গদি রক্ষায় ববি শিক্ষকদের গোপন ভিডিও ফাঁস হয়, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফাঁস হওয়া এক ঘণ্টা ৩০ মিনিটের ভিডিওতে মোট ১৩ শিক্ষককে হাসিনার গদি রক্ষায় বিভিন্ন ফন্দিফিকির এঁটে বক্তব্য দিতে এবং শিক্ষার্থীদের এক দফার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে দেখা যায়। এমনকি এক দফার পক্ষে থাকা সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে যে কোনোভাবে প্রতিহত করার হুমকিও দেওয়া হয় ওই মিটিংয়ে। ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাদের পুনর্বাসন করেছেন সাবেক উপাচার্য শুচিতা শরমিন। এমনকি সেই মিটিংয়ে জুলাই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শিক্ষককে ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যা দিয়ে অপসারণ করেন তিনি।
জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষকদের অধিকাংশই ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে নৌকার মাঝি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে নৌকা মার্কায় প্রচার চালাতে ২০২৩ সালের ১০ মে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আবদুল বাতেন চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ববি শিক্ষকদের একটি কমিটি করা হয়। গোপন সভায় অংশ নেওয়া এই শিক্ষকদের অধিকাংশই সে কমিটির সদস্য ছিলেন এবং সে সময় পাঠদান বিলম্ব করে অফিস সময়েও রাস্তা ও বাজারে নেমে নৌকার জন্য ভোট চেয়েছিলেন।
অভিযুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনি প্রচার কমিটির আহ্বায়ক ড. আবদুল বাতেন চৌধুরী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তারেক মাহমুদ আবির, মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবদুল কাইউম, সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও লোক-প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ইসরাত জাহান, মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন, কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন এবং ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ তানভীর কায়সার ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান দিল আফরোজ খানম উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ড. বাতেন গোপন সভায় শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিকে ‘ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান’করাসহ হাসিনার বিপক্ষে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে দীর্ঘ বক্তব্য দেন। এমনকি কারা শেখ মুজিবের আদর্শের সৈনিক এবং কারা বিপক্ষের-তা এখনই বোঝা যাবে বলে হুংকার দেওয়া এই শিক্ষক বর্তমানে ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া এখনো মূল্যায়ন কমিটির সদস্য এবং ক্লাস্টার-২-এর আহ্বায়ক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে আছেন।
হাসিনার গদি রক্ষার সেই গোপন সভার মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যে কোনোভাবে প্রতিহত করে শেখ হাসিনার পাশে থাকার আশ্বাস দেওয়া তৎকালীন প্রক্টর ড. কাইউমও দাপটের সঙ্গে বহাল আছেন। জুলাই আন্দোলনকারী এবং তাদের সমর্থনকারী শিক্ষকদের কঠোর হস্তে দমনের হুমকিও দিয়েছিলেন এই শিক্ষক। বর্তমানে তিনি মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। এছাড়া তিনি দু-একটি অর্থবণ্টন ও অর্থসংশ্লিষ্ট কমিটিতেও আছেন বলে জানা গেছে।
বর্তমানে ব্যবসা অনুষদের ডিন হওয়ার জন্য নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনি প্রচার কমিটির ১২ নম্বর সদস্য ড. কাইউম। এর আগে তিনি ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বিসিসি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর রাজনৈতিক কর্মী। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কালীবাড়ি রোডে সেরনিয়াবাত ভবনে তাকে পাওয়া যেত। জুলাই আন্দোলনের সময় রাতে শিক্ষার্থীদের মেসে মেসে পুলিশ দিয়ে তল্লাশি চালানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
শিক্ষার্থীদের ওপর তার পরোক্ষ মদতে হামলা হওয়ার অভিযোগও আছে। তিনি প্রক্টরের দায়িত্বে থাকাকালীন তার ও পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতেই ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গত বছরের ২৯ জুলাই হামলা চালায় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ বিষয়েও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি; বরং ছাত্রলীগের প্রতি তার সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখা যায় এবং হামলা তার পরোক্ষ মদতেই হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে ড. কাইউমের স্ত্রী ড. ইসরাত জাহানও ফ্যাসিবাদের গদি রক্ষার সভায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ‘শেখ হাসিনাই একমাত্র ভরসাস্থল ও তার প্রতি আস্থা রাখতে চান’ বলে বক্তব্য দেন। এছাড়া ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনি প্রচার কমিটির ১০ নম্বর সদস্য ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি লোক-প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান, সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে বহাল আছেন। জানা গেছে, এই দম্পতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছেন।
হাসিনার গদি বাঁচানোর সভায় ফ্যাসিবাদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনি প্রচার কমিটির ৫ নম্বর সদস্য, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তারেক মাহমুদ আবির। সভায় তিনি কারা এক দফার পক্ষে আছেনÑতাদের দেখতে চান এবং হাসিনার জন্য কিছু করে দেখানোর এখনই সময় বলে বক্তব্য দেন। তিনি এখনো মূল্যায়ন কমিটির সদস্যপদ দখল করে আছেন এবং নানাভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রভাব খাটাচ্ছেন।
ষড়যন্ত্রের ওই সভায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া শিক্ষক জামাল উদ্দিনও মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া গোপন সভায় বক্তব্য দেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও ২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনি প্রচার কমিটির দুই নম্বর সদস্য মোহাম্মদ তানভীর কায়সার। তিনিও বর্তমানে বিভাগের চেয়ারম্যান এবং কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন হিসেবে বহাল আছেন। সেই সভায় গণহত্যাকারী হাসিনার জন্য দুঃখে গলা ধরে আসা এবং আবেগে কথা বলতে না পারার মতো কান্নাজড়িত পরিবেশ তৈরি করা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা দিল আফরোজ খানমও বর্তমানে বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন দাপটের সঙ্গে।
২০২৩ সালের বিসিসি নির্বাচনে নৌকার নির্বাচনি প্রচার কমিটির সাত নম্বর সদস্য এবং গণিত বিভাগের শিক্ষক ড. হেনা রানী বিশ্বাস, ড. শফিউল আলম, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আরিফ হোসেন, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষক ড. আবদুল্লাহ আল মাসুদ, আইন বিভাগের শিক্ষক সুপ্রভাত হালদার ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. খোরশেদ আলম শিক্ষার্থীদের এক দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ করে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দেন। বর্তমানে তারাই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে অগ্রাধিকারের তালিকায় আছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি তুলেছেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা ও নিজ স্বার্থে গণহত্যাকারীকে টিকিয়ে রাখতে এমন ঘৃণ্য সমর্থন দেওয়া নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ। ওই সভায় অংশ নেওয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েরও দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তারা।
এ বিষয়ে লোক-প্রশাসন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মোকাব্বেল শেখ বলেন, ‘নতুন উপাচার্যের কাছে বারবার দাবি জানিয়েছি, যারা জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেনÑতাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোনো লাভজনক পদে যেন তারা থাকতে না পারেন। কিন্তু তিনি এখনো আমাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। তার এই নির্লিপ্ততা উদ্বেগজনক।’
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াহিদুর রহমান বলেন, ‘যারা এক দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নে ইন্ধন দিয়েছিলেন, তারা আজ পদোন্নতির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। আমাদের স্পষ্ট দাবি, এসব ফ্যাসিবাদপন্থি শিক্ষকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত যেন কোনো মূল্যায়ন বোর্ড না বসে।’
নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারে জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকা ও বিবৃতি দেওয়া শিক্ষকদের একজন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল আলিম বছির। এ বিষয়ে তিনি আমার দেশকে বলেন, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে। ইস্যুটি জটিল হলেও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সেই সভায় তোপের মুখে পড়া ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মুহাম্মদ মুহসিন উদ্দীন বলেনÑডিন, চেয়ারম্যান এগুলো একাডেমিক পদ। যদি কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ থাকে কিংবা বিভাগীয় তদন্ত চলমান থাকে, সেক্ষেত্রে উপাচার্য চাইলে তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ উপাচার্যের এখতিয়ার।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিক আলম আমার দেশকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আছে, পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সত্যতা যাচাই করে বিধি অনুযায়ী যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।’