Image description

মাত্র ১৮০ থেকে ১৯০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানের সব কয়টি বিভাগে শিক্ষার্থীর সংকট চরম সংকট ধারন করেছে। কোন ব্যাচে ৩ জন, আবার কোনো ব্যাচে ৬ জন শিক্ষার্থী- এমন সংখ্যাতেই চলছে বিভাগগুলো। শিক্ষার্থী সংকট, প্রশাসনিক স্থবিরতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের নিষ্ক্রিয়তায় প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যেমন হুমকির মুখে পড়েছে, তেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।

জানা যায়, ২০১৭ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে তিনটি অনুষদের অধীনে পাঁচটি বিভাগ রয়েছে। পরিবেশনকলা অনুষদের অধীনে সংগীত বিভাগ, নাট্যকলা বিভাগ, নৃত্যকলা বিভাগ; নকশা ও উদ্ভাবন অনুষদের অধীনে ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগ এবং ব্যবসাবিদ্যা অনুষদের অধীনে ব্যবসা প্রশাসন বিভাগ।

কিনউ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার্থী সংকটে বিশ্ববিদালয়টি পরিচালনায় হিমসিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। খোঁজে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে নকশা ও উদ্ভাবন অনুষদের অধীনে ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগ। বিভাগটিতে বর্তমানে ৭টি ব্যাচে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। প্রথম ব্যাচে ভর্তি হয়েছিল ২০ জন; যেখানে বর্তমানে মাত্র ৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। দ্বিতীয় ব্যাচে ভর্তি হয়েছিল প্রায় ৩০ জন; বর্তমানের এই সংখ্যা ৩ জনে। তৃতীয় ব্যাচেও রয়েছে মাত্র ৫ জন শিক্ষার্থী। ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী, বিভাগপ্রতি স্থায়ী চারজন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও বিভাগটিতে বর্তমানে একজন পার্ট টাইম শিক্ষক রয়েছেন। এছাড়া আরেকজন শিক্ষককে বিভাগটির উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। এমন অবস্থায় বিভাগটির প্রথম ব্যাচের ৭ম সেমিস্টার পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। অন্যান্য বিভাগগুলোর অবস্থাও একই রকম।

‘বিভাগে যে আশা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলায় আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকারে পড়ে গেছে। আমাদের বিভাগে পার্ট টাইম শিক্ষক দিয়ে চলছে। একজন ম্যাম ছিলেন, ওনিও দীর্ঘদিন বিভাগে আসেননি। ফলে আমাদের ৭ম সেমিস্টারের পরীক্ষায় আটকে আছে। আমরা দ্রুত এ সমস্যার সমাধান চাই।’— শিক্ষার্থী

শুধু একাডেমিক সংকটই নয়, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং সেবাব্যবস্থাও শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ বিল কমানোর জন্য কখনো কখনো বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিন মাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় কর্তৃপক্ষ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। 

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের অনেক সদস্য দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। এতে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। গত ১৭ আগস্ট শিক্ষার্থীরা ইউজিসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব সমস্যার কথা তুলে ধরেন। ট্রাস্টি বোর্ডে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক-দেড় বছরেও কোনো সভায় অংশ নেননি। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হচ্ছে, আমরা পড়াশোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। 

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির এমন নাজুক অবস্থায় থাকার কারণে সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন অভিভাবকরা। এমন অবস্থায় অনেক অভিভাবক সন্তানদের ভর্তি বাতিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী সংকটের পাশাপাশি আস্থার সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে। অভিভাবকরা বলছেন, ‘পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। প্রশাসনিক অচলাবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’

নাম প্রকাশ না করতে ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিভাগে যে আশা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলায় আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকারে পড়ে গেছে। আমাদের বিভাগে পার্ট টাইম শিক্ষক দিয়ে চলছে। একজন ম্যাম ছিলেন, ওনিও দীর্ঘদিন বিভাগে আসেননি। ফলে আমাদের ৭ম সেমিস্টারের পরীক্ষায় আটকে আছে। আমরা দ্রুত এ সমস্যার সমাধান চাই।’

বিশ্ববিদ্যালয়টির সহযোগী অধ্যাপক ও একাডেমিক উপদেষ্টা ড. ইসলাম শফিক বলেন, ‘ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগে শিক্ষক স্বল্পতা ছিল সেটি সমানের লক্ষ্যে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে এবং গত ২৩ আগস্ট ভাইভা নেওয়া হয়েছে। ইউজিসির নীতিমালা অনুসরণ করেই আমরা শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি। খুব শিঘ্রই এ সংকট কেটে যাবে এবং শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবেন।’

‘আমরা ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে অবহিত করেছি। আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যদি তারা আইনানুগ এই বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হন, তবে কমিশন আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।’—অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, সদস্য, ইউজিসি

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. লে. কর্ণেল মাহমুদ উল আলম (অব.) বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ডের যে নিষ্ক্রিয়তা সেটি তো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তবে যতটুকু শুনেছি, তারা আবারও বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় হচ্ছেন। বিদ্যুৎ বন্ধের যে ব্যাপারটি সেটির কোন অনুমতি প্রকাশ্যে বা গোপনেও ছিল না। এটি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়াচ্ছে। ফ্যাশন ডিজাইনে শিক্ষক সংকটের কারণ হলো, ফ্যাশন ডিজাইনে এখনো সেরকম গ্র্যাজুয়েট তৈরি হয়নি। সেজন্য এ বিভাগে শিক্ষক পাওয়া যায় না। তারপরেও আমরা শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রয়েছি। খুব শীঘ্রই এর সমাধান হবে।’

ব্যবস্থা নিচ্ছে ইউজিসি
বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব চিত্র সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সম্প্রতি ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের সময় তারা বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ পান এবং একাধিক অনিয়মের বিষয়ে নিশ্চিত হন বলে ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে। এসব অনিয়মের মধ্যে প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাব, একাডেমিক কার্যক্রমে শৃঙ্খলার ঘাটতি ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অবহেলার অভিযোগও রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউজিসি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, যদি সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ইউজিসি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগে কোনো শিক্ষক না থাকাটা অত্যন্ত হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক বিষয়। বর্তমানে এই বিভাগের একেবারেই নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী, প্রতিটি বিভাগে ন্যূনতম চারজন স্থায়ী শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ, এই বিভাগে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নিযুক্ত নেই, যা সরাসরি আইনের লঙ্ঘন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিভাগটিতে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে অবহিত করেছি। আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যদি তারা আইনানুগ এই বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হন, তবে কমিশন আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।’