
দূরপাল্লার বাসের ড্রাইভার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তার একমাত্র সন্তান মোহাম্মদ যুবায়ের জুলাই আন্দোলনের আহত যোদ্ধা।অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে কথা বলছিলাম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? হাসি দিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি”। জানতে চাইলাম, ছেলের চিকিৎসা পাচ্ছেন? বললেন, “ফ্রি চিকিৎসা পাচ্ছি। সরকারের থেকে অনুদান দুই লাখ টাকা এ পর্যন্ত পেয়েছি। ” জিজ্ঞেস করলাম, এক বছর পরও চিকিৎসা নিচ্ছেন? ম্লান হেসে উত্তর দিলেন, “পেটে আর বুকে লাগা গুলি প্রথমে বের করলেও বার বার ইনফেকশন হচ্ছে। অনেকবার অপারেশন হয়েছে, একটু ভালো হয় আবার আরেক দিক দিয়ে ফুলে ওঠে। অনেক কষ্টে পাওয়া এবারের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। আরও কতদিন ছেলে নিয়ে ভুগব তা একমাত্র আল্লাহই জানেন!”
প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, দেশের অর্থনীতির হালচাল কী বুঝছেন? জাহাঙ্গীর বললেন, “এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিকে ব্যাংকে নিজের একাউন্টের টাকা তুলতে গেলে অফিসার বলতো, ব্যাংকে টাকা নাই, কয়েকদিন ঘুরিয়ে অল্প অল্প টাকা দিত। অনেক কষ্টে নিজের জমানো টাকা হাতে পাব কি না, তা নিয়ে ভয়ই পেয়েছিলাম। এখন ব্যাংক টাকা নাই বলছে না। ” জানতে চাইলাম, জিনিসপত্রের দাম কেমন দেখছেন? উত্তরে তিনি বললেন, “এবারের রমজানে জিনিসপত্রের দাম তো কমই ছিল। এখন আবার বাড়তির দিকে। ”
এরপর কথা বললাম কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচা করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মিন্টুর সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম, ডলার বাজার কেমন? হেসে বললেন, “মার্কিন ডলারের দাম তো এখন বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ১৫ মে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বাণিজ্যিক ব্যাংক ও গ্রাহকের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি করছে, ডলারের দামের একটি ভিত্তি মূল্য ঠিক করে দিচ্ছে। ফলে আওয়ামী সরকারের আমলে ২০২১ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া ডলার সংকট ২০২২ ও ২০২৩ সালে আরও প্রকট হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে ১২০ টাকা নির্ধারণ করে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত কমবেশি করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে বাজার স্বাভাবিক হয়েছে। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করায় মোটামুটি স্বাভাবিক আছে। ”
ব্যাংকার তানভীর হাসনাইন মঈনের কাছে জানতে চাইলাম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, প্রবাসীদের পাঠানো টাকা বা রেমিট্যান্স এবং আমদানি রপ্তানির কথা। বললেন, “বর্তমান সরকারের এই এক বছরে ব্যাংক খাতে সংস্কার হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স আগের বছরের চেয়ে বাড়ার যে ধারা, তা অব্যাহত রয়েছে। রপ্তানি আয়ও প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মুখ থুবরে পড়েছিল যে রিজার্ভ, তার ক্ষয় বন্ধ হয়েছে, এখন বাড়ছে। ”
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়। ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার বর্ষপূর্তি হলো। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি ১০ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকে উন্নতি হয়েছে। গত সরকারের আমলে ডলারের যে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল, তা আয়ত্তের মধ্যে এসেছে। রিজার্ভ সংকট কেটেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে। অর্থাৎ এক বছর আগে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে নাজুক পরিস্থিতি ছিল, সেটি কেটে গেছে। তবে মূল্যস্ফীতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। রাজস্ব আহরণও বাড়েনি। বিনিয়োগ খরা কাটেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিনিয়োগ না বাড়ায় থমকে আছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ। অর্থাৎ অর্থনীতির মৌলিক সমস্যাগুলোর দুর্বলতা থেকে গেছে।
ফিরে দেখা ফ্যাসিস্ট আমলের দেশের অর্থনীতি
২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকার। একটানা ১৫ বছর দেশকে শাসন করে এই রাজনৈতিক দলের সরকার। বলা হয়, একটানা সরকার ব্যবস্থা চললে উন্নয়ন কর্মসূচির ধারাবাহিকতা থাকে, ফলে ঘটে দেশের উন্নয়ন। গত ১৫ বছরে সরকার দেশের মানুষের কাছে প্রচার করেছে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আর মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রজেক্ট দেখিয়ে বলা হয়েছে, এই হচ্ছে দেশের উন্নয়ন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য প্রকাশ বা বলার মতো পরিবেশ রাখেনি। ফলে ২০২৪ সালের জুলাই গণআন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা বের করে প্রতিবেদন তৈরি করতে ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট গঠিত হয় ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এই কমিটির রিপোর্টে গত সরকারের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র বের হয়ে আসে। রিপোর্টে বলা হয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের ত্রিমুখী আঁতাত দেশের অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত সৃস্টি করেছে।
অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট
১। গণতন্ত্রের অভাবে সীমাহীন দুর্নীতি
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি সম্পদের ব্যাপক অপচয় এবং সরকারের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অপব্যহার হয়েছে। এই অপশাসনের কারণ গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব, যার পেছনে রয়েছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রতারণার নির্বাচন। এর ফলে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার গড়ে ওঠে, যা রক্ষায় ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, আমলাদের একটি অংশ এবং এলিট ব্যবসায়ীদের মধ্যে আঁতাত গড়ে ওঠে। উন্নয়নবিরোধী এই আঁতাত দেশের আইন, বিচার এবং নির্বাহী বিভাগকে ক্ষয়িষ্ণু করার পেছনে ভূমিকা রাখে। তাদের প্রভাবে সরকার বহির্ভূত বিভিন্ন পক্ষ যেমন—গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং বেসরকারি খাত নিজেদের ওপর ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করে। স্বার্থান্বেষী পুঁজিবাদের বিশেষ সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বা অলিগার্কের উত্থান ঘটে। এই অলিগার্করা রাজনৈতিক শাসন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। আর সরকার অতি মূল্যায়িত ও ভুল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে উন্নয়নের একটি ভ্রান্ত বয়ান প্রচার করে।
২। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় ব্যাংক খাতে
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে—ভৌত অবকাঠামো, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত। রাজনৈতিক প্রভাবে দেওয়া হয় ব্যাংক ঋণ, যা এ খাতের সংকটকে তীব্র করেছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাড়ায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে ২৪টি পদ্মাসেতু এবং ১৪টি মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব।
ব্যাংক ঋণে ‘হাই প্রোফাইল’ কেলেঙ্কারি আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। উৎপাদনশীল খাত থেকে পুঁজি অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে। বড় কিছু শিল্প গ্রুপ ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়, ব্যাংক খাতের সমস্যাগ্রস্ত ঋণের মধ্যে স্বীকৃত খেলাপি ঋণ দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণ অবলোপন হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট অর্থাৎ খেলাপি হওয়ার আগের পর্যায়ে রয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা।
ভৌত অবকাঠামোতে দুর্নীতি বিষয়ে বলা হয়েছে, বড় আকারের প্রকল্পগুলোতে ৭০ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। গত ১৫ বছরে এ ধরনের প্রকল্পে ৬০ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৬১ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং অতি মূল্যায়নের কারণে ক্ষতি হয়েছে।
কমিটি সার্বিকভাবে যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে, তার একটি তালিকা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—ব্যাংক ঋণে জালিয়াতি, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় জোরপূর্বক ব্যাংক দখল, বিদেশে অর্থ পাচার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অলাভজনক প্রকল্প গ্রহণ, কৃত্রিমভাবে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতাহীন দরপত্র প্রক্রিয়া, কাজ পেতে ঘুষ, নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, উন্নয়নের নামে সরকারি তহবিল থেকে রাজনৈতিক তহবিল ও নেতাদের ব্যক্তিগত তহবিলে অর্থ স্থানান্তর, প্রভাবশালীদের কর ছাড়, কাজ পাইয়ে দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের কমিশন দেওয়া ইত্যাদি।
৩। কোথায় কীভাবে পাচার হয়েছে
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা, আইএমএফের উপাত্ত, প্রকাশিত সংবাদ এবং এসবের ভিত্তিতে নিজস্ব অনুমানের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের পরিমাণ প্রাক্কলন করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে বাড়িয়ে বা কমিয়ে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে। সেসব পাচার করা অর্থে ওই সব দেশে কেনা সম্পদের মূল্য করা হয়েছে পরিশোধ। বাংলাদেশ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত এবং ‘করের স্বর্গ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জনশক্তি রপ্তানিতে ভিসা কেনার প্রক্রিয়ায় রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গত এক দশকে হুন্ডিতে ১৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে ঢাকায় উত্তরা-মতিঝিল রুটের মতো চারটি মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় মেটানো যায়।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি রিপোর্টের ২০২৪ এর তথ্য অনুযায়ী, দুবাইতে ৪৫৯ বাংলাদেশির ৯৭২টি আবাসিক স্থাপনা রয়েছে, যার মূল্য প্রায় তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘করের স্বর্গ’ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। ‘অ্যান্ড স্নো ওয়াশিং’ নামে একটি সংস্থার প্রতিবেদনে কানাডায় বাংলাদেশিদের পাঁচ লাখ ৬৪ কোটি থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো সম্পদের প্রাক্কলন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশিদের তিন হাজার ৬০০’র বেশি স্থাপনা রয়েছে।
৪। পরিসংখ্যান জালিয়াতি
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জিডিপি, বিনিয়োগ, রপ্তানিসহ বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জালিয়াতি হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেভাবে দেখানো হয়েছে ততটা হয়নি। মূল্যস্ফীতি বিভিন্ন সময়ে কম দেখানো হয়েছে। কমিটি পরিসংখ্যান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে পরিসংখ্যানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের তথ্য পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশি মাত্রায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। রপ্তানির তথ্য যে বেশি দেখানো হয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় প্রমাণ হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তথ্যও বেশি দেখানো হতো, যা আইএমএফের হস্তক্ষেপে পরে সংশোধন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার ভাতা দেওয়া হয়নি। ২০২২ সালে ৭৩ শতাংশ ভাতাভোগী দরিদ্র ছিল না। রিপোর্টে মত প্রকাশ করা হয় যে, দেশের দুই কোটির বেশি মানুষ যদি দুই দিন কাজ করতে না পারে, তাহলে তারা দারিদ্র্যের সীমারেখার মধ্যে পড়ে যাবে। এ অবস্থা থেকেই বৈষম্যের চিত্র বোঝা যায় বলে মত প্রকাশ করেছে কমিটি।
৫। মূল্যস্ফীতি
প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতির ওপর বিস্তারিত পর্যালোচনা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করার পাশাপাশি গত সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির হার অনেক সময় কম দেখানো হয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে ৯ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। প্রকৃত এর হার ছিল ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনের ভূমিকায় মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় উৎপাদনের তথ্য জালিয়াতি করা হয়েছে। সেইসাথে চাল, ভোজ্যতেল ও গমের মতো মৌলিক কিছু পণ্যের চাহিদা কম দেখানো হয়েছে। ফলে আমদানি হয়েছে কম, অস্থির হয়েছে বাজার। ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী গ্রুপকে বিভিন্ন নীতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হলেও ক্রেতাদের কষ্ট কমেনি। মজুতের বিষয়টি যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ না করায় দুরাবস্থা আরও বেড়েছে।
বর্তমানের অর্থনৈতিক চিত্র
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের বিভিন্ন খাতের মধ্যে সাফল্যের খাত হচ্ছে অর্থনৈতিক খাত। ফ্যাসিস্ট সরকারের ফেলে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করায় এখনও টিকে আছে বাংলাদেশ। অবশ্য এর কৃতিত্ব অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের, এরপর অন্যদের। তবে এ নিয়ে সরকারের নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সামনে রয়ে গেছে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ।
সরকারের সামনের চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে প্রথমত রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানোর চাপ। পাশাপাশি বাড়াতে হবে রাজস্ব আয়। সেইসাথে কাটাতে হবে বিনিয়োগ স্থবিরতা। রয়ে গেছে নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর করার চ্যালেঞ্জ।
(ক) মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে ২০২১ সাল থেকেই সাধারণ মানুষ বেশ কষ্টে আছেন। ১৯৮৬ সালের পর দেশে কখনোই এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২৪-এ পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশে পৌঁছেছিল। আর ২০২৪ এর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসেই দুই অংকের ঘরেই ছিল মূল্যস্ফীতি। গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। কিন্তু বিদায়ী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে’র হিসাবে, গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। তবে গত ১১ মাসে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এই হার ওঠে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ঝুঁকিতে থাকা প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদরিদ্র হয়ে যেতে পারেন।
চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ সালে মূল্যস্ফীতি কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামার পূর্বাভাস দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি লক্ষ্য ৬ শতাংশের ওপরে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও নিচের মাত্রায় নামিয়ে আনতে চায়।
(খ) রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এনবিআর ২৭ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। মাসটির রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা কম। যদিও গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত অর্থবছর বা ২০২৪-২৫ এর জুলাইয়ে আদায় হয়েছিল ২১ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। এনবিআরের প্রতিবেদেন দেখা গেছে, ২০২৫ জুলাইয়ে এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ১১১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর একমাত্র কার্যকর উপায় হলো কর ফাঁকি কঠোরভাবে রোধ করা।
রাজস্ব খাতের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উদ্যোগ হলো কর ও শুল্ক বিভাগকে আলাদা করা। রাজস্ব কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের মুখে পড়লেও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। সমালোচকরা তার এই উদ্যোগকে প্রশংসা করেছেন। তাদের অনেকে এটিকে সাহসী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, যেকোন ধরনের সংস্কার আনতে গেলে প্রতিরোধ আসবে, তা যে কঠোরভাবে সামাল দিতে হয়, এটিই তার একটা বড় উদাহরণ।
(গ) বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে প্রভাব
অর্ন্তবর্তী সরকারের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ বিনিয়োগে গতি ফিরিয়ে আনা। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ কমে গেছে, এটি হচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এখনো আস্থা পাচ্ছেন না। এর পাশাপাশি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাময়িকভাবে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা চলছে, এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এদিকে, সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ দশমিক ০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়। এতে তারল্য সংকট আরও তীব্র হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের জন্য ঋণের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। ফলে বাড়তে পারে সুদের হারও, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করবে।
(ঘ) নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার চ্যালেঞ্জ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মাধ্যমেই দেশ গণতন্ত্রের উত্তরণে এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের বছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা শ্লথগতি থাকে। এসময়ে নতুন ব্যবসা চালুর ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা মন্দাভাব থাকে। তবে নির্বাচন কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হয়।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে তফসিল ঘোষণা হলেই দেশ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়বে। সরকারও তখন মনোযোগী হয়ে পড়বে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের দিকে। সেক্ষেত্রে কঠিন ও অজনপ্রিয় কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই আগামী কয়েক মাস অর্থনীতির সামনে রয়েছে বড় পরীক্ষা। তবে নির্বাচনের ভোটে জিতে বিজয়ী সরকার কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করবে, এই হোক জুলাই গণআন্দোলনে জেতা রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার। কেননা একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই টিকিয়ে রাখে দেশের অর্থনীতি। আর অর্থনীতি টিকলে বাঁচবে বাংলাদেশ। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সোনার বাংলাদেশ।
শারমীন রিনভী, সিনিয়র সাংবাদিক