
এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষার ৩০০ থেকে ৫০০ খাতা মূল্যায়নের জন্য একজন শিক্ষক সময় পান মাত্র ১৫ দিন। একই সঙ্গে ঐ শিক্ষককে নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও পালন করতে হয়। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন ও স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করে আসছেন একশ্রেণির শিক্ষক। এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ গোপন সূত্র থেকে পেয়ে এবার সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা বোর্ড।
চিঠিতে বলা হয়েছে, আইনগতভাবে এ ধরনের কাজ অবৈধ এবং এমন অপরাধ করলে তার দুই বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। তবে এই হুঁশিয়ারির পর অনেক শিক্ষক খাতা মূল্যায়নে অনীহা দেখাচ্ছেন, যার ফলে মূল্যায়ন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষকরা আরো সময় দাবি করেন। এছাড়া, প্রতি খাতায় মাত্র ৩৫ টাকা সম্মানী, যা পেতেও বছরের বেশি লেগে যায়। প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং থেকে বেশি আয়ের সুযোগও খাতা দেখা থেকে দূরে রাখছে অনেককে।
অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষকদের আত্মীয়স্বজন কিংবা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষার খাতা দেখানোয় অনেক ক্ষেত্রে বড় ভুল হয়। এর প্রভাব পড়ে ফলাফলে। অথচ সারা বছর ধরে একজন শিক্ষার্থী এসএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। পরীক্ষা ভালো দিয়েও শিক্ষকরা সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না করায় হয়তো তার ফল খারাপ আসে। বর্তমান সময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর আশাহত হয়ে খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর আগের তুলনায় বেশি নম্বর পাওয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তদন্তেও পরীক্ষকদের ভুলের বিষয়টি উঠে এসেছে।
এদিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলেন, ফল পুনর্নিরীক্ষণের অর্থ নতুন করে খাতা দেখা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় না। মূলত উত্তরপত্রের নম্বর যোগফলে কোনো ভুল হয়েছে কি না ও বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কি না, তা দেখেই ‘পুনর্নিরীক্ষণ’ শেষ করা হয়। ফলে ফলাফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই থাকে। অথচ পুনরায় খাতা দেখলে বেশির ভাগ আবেদনকারীর ফল পরিবর্তন হতো।
পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন বেড়ে যাওয়ায় ও পরীক্ষকদের ভুল নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ বিষয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু)। গবেষণায় খাতা মূল্যায়নে ত্রুটিপূর্ণ হচ্ছে বলে প্রমাণ মেলে। এতে উঠে এসেছে, ভুল উত্তরের জন্য নম্বর দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু অনেক সময় সঠিক উত্তরের ক্ষেত্রেও নম্বর কম দেওয়া হচ্ছে। প্রধান পরীক্ষকদের খাতা ফের দেখে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেই কাজ ঠিকভাবে করেন না। এছাড়া স্কুল-কলেজের নামকরা শিক্ষকরা খাতা দেখেন না বলেও প্রমাণ পেয়েছে বেডু।
গত ১৩ মে এসএসসির তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হলেও পরীক্ষকরা বোর্ড থেকে মূল্যায়নের জন্য খাতা নিতে যাচ্ছিলেন না। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে অনীহা প্রকাশ করায় প্রধান পরীক্ষক ও পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা।
শিক্ষক নেতারা বলেন, বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটির মতো বিষয়ে পরীক্ষক কম, কিন্তু খাতা বেশি। তাই একজন পরীক্ষককে ৫০০ থেকে ৬০০ খাতা মূল্যায়নে সময় দেওয়া হয় মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিন। শিক্ষকদের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে কোনোভাবেই এসময়ের মধ্যে খাতা দেখা সম্পূর্ণ করা সম্ভব না।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষক নিয়োগে নীতিমালা থাকলেও (প্রধান পরীক্ষকের ১২ বছর, পরীক্ষকের ৫ বছর অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠানের ফল বিবেচনা) তা মানা হয় না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সম্মতিতেই পরীক্ষক হওয়া যায়, ফলে জুনিয়র সেকশন বা কলেজের শিক্ষকরাও মাধ্যমিকের খাতা দেখছেন। আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের ডিজিটাল ডেটাবেজেও গাইডলাইন ছাড়াই ঢুকছেন অযোগ্যরা। এদিকে শিক্ষকরা বলেন, প্রতি খাতা মূল্যায়নের ফি ৫০ টাকা হওয়া দরকার।
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের রেওয়াজ রয়েছে। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল আগামী জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করার লক্ষ্য ধরে কাজ করছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। শিক্ষা বোর্ডগুলোর মোর্চা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের রেওয়াজ আছে। সেভাবেই ফল প্রকাশ করা হবে। গত ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ১৩ মে পর্যন্ত চলে এসএসসি ও সমমানের তত্ত্বীয় পরীক্ষা। ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ হয় ২৫ মে। সেই অনুযায়ী ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে ফল প্রকাশ করতে পারব। এবার মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছিলেন। তবে ৩০ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী এক বা একাধিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন।