
গত ক’বছর ধরে আবাসন খাতে স্থবিরতা চলছে। ফ্ল্যাট-এপার্টমেন্টের দাম বেড়ে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এ খাতকে আরও উস্কে দিয়েছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ‘ড্যাপ’। এর কারণে আবাসন খাত সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। গত দুই বছর ধরে নকশা অনুমোদন কমে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে আবাসন ব্যবসায়ী ও জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা ইমারত নির্মাণ বন্ধ রেখেছেন। ফলে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। এসব নানান সংকটের মাঝে অর্থনীতিতে ১৫ শতাংশ অবদান রাখা এই খাতের বিভিন্ন উপকরণের ওপর প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়তি শুল্ক-কর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’- হিসেবেই দেখছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নির্মাণের মূল উপকরণ রড ও সিমেন্ট উৎপাদনে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। নির্মাণ কোম্পানির সেবার ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া তারকাঁটা, নাট, বোল্টসহ বিভিন্ন খুচরা উপকরণেও বাড়ানো হয়েছে ভ্যাট। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন খাতে কোনো সুখবর নেই। ফলে এসবের প্রভাবে ভবন এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
করের আওতা আরও বেড়েছে: নির্মাণ খাতে আরও কিছু পদক্ষেপ রয়েছে, যার প্রভাব ক্ষেত্রভেদে ভিন্ন হবে। জমি বিক্রেতার হাতে যাতে কালো টাকা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য প্রকৃত বিক্রয়মূল্যে সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনের লক্ষ্যে জমি হস্তান্তর থেকে মূলধনি মুনাফার ওপর উৎসে কর কমানো হয়েছে। জমির রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) খরচ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সমবায়ভিত্তিক আবাসনে সদস্যদের মধ্যে জমি হস্তান্তরে কর অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে করদাতা বাড়াতে সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচা বা হস্তান্তরের সময় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ দেখানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
এদিকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত সম্পদ বা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখলেও- সেজন্য করের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এজন্য কর বাড়ানো হয়েছে পাঁচগুণ পর্যন্ত। যাকে এককথায় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’- হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া জানান, রড ও সিমেন্টের কাঁচামালের কর বাড়লে ভবন-ফ্ল্যাটের মূল্য বাড়বে। আবার জমির মৌজা মূল্য বাড়ালেও ব্যয় বাড়বে। এতে ক্রেতা কমবে, সংকটে পড়বে নির্মাণ খাত। তিনি বলেন, জমির নিবন্ধন খরচ কমানোর উদ্যোগ ভালো। তবে জমির মৌজা মূল্য বাড়ালে প্রকৃত খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আবাসনে কালো টাকা বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বৈধ আয়ের যে অংশ কর দেয়া হয়নি, সে অংশ বিনিয়োগের সুযোগ রাখার কথা বলি। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো- সুযোগ থাকার পরও এমন অর্থ আবাসনে খুব বেশি বিনিয়োগ হয় না। এরপর এবার পাঁচগুণ পর্যন্ত করা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে যা বরং বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করাই। কেউ এত টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনবে না।
রড-সিমেন্টের ওপর বাড়তি কর: নির্মাণ খাতের অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল রডের উৎপাদন পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কর ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর ওপর আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। আমদানি করা অথবা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত পুনর্ব্যবহারযোগ্য লোহার খণ্ড বা স্ক্র্যাপ থেকে রড উৎপাদনে প্রতি টনে ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা। এটি বাড়িয়ে ১ হাজার ৭০০ টাকা করা হয়েছে। আমদানি করা অথবা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত গলনযোগ্য স্ক্র্যাপ থেকে ধাতব ব্লক বা বিলেট উৎপাদনে ভ্যাট ১ হাজার ২০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। সব ধরনের বিলেট থেকে রড উৎপাদনে ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা, যা বাড়িয়ে ১ হাজার ৬০০ টাকা করা হয়েছে। স্ক্র্যাপ থেকে বিলেট উৎপাদনে ভ্যাট ছিল ২ হাজার ২০০ টাকা, যা বাড়িয়ে ২ হাজার ৭০০ টাকা করা হয়েছে। সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিঙ্কার আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক ছিল ৭০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা। এখন প্রতি টনের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে, যা আগের চেয়ে খরচ বাড়াবে। সিমেন্ট শিট উৎপাদনে ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচা: অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগে গুলশানে ২ হাজার ৪০০ বর্গফুট আকারের ফ্ল্যাট কিনলে যেখানে আগের কর ছিল ১৩ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হচ্ছে ৪৮ লাখ টাকা। বাড়তি করের হার ২৫৯ শতাংশ। একইভাবে ভবন নির্মাণে কর বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ পর্যন্ত। জমি বা ভবন হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের চেয়ে যদি অতিরিক্ত অর্থ লেনদেন হয়, তবে তা ব্যাংকিং মাধ্যমে প্রদর্শন করতে হবে। অন্যথায় তা কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আগে কেউ মৌজা মূল্যের কারণে দলিল কম মূল্যে করে থাকলে তিনি অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকে থাকার প্রমাণ দিয়ে তাতে প্রযোজ্য হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ পাবেন। ফ্ল্যাট, জমি, দোকান বা ভবন কেনাবেচার সময় রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। আগে ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে এই শর্ত থাকলেও এবার যে কোনো মূল্যের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য হবে। এই পদক্ষেপের কারণে করজাল সমপ্রসারিত হবে এবং রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কোন এলাকায় কত কর বাড়াবে: বর্তমানে গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাসহ ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে ২০০ বর্গমিটারের বেশি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে মূল্য যা-ই হোক, প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৬ হাজার টাকা নির্ধারিত কর দিতে হয়। আর ২০০ বর্গমিটারের কম আয়তনের এপার্টমেন্ট হলে, প্রতি বর্গমিটারের জন্য কর ৪ হাজার টাকা। রাজধানীর অন্যান্য এলাকা যেমন- মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি, মহাখালী, লালমাটিয়া, উত্তরা, বসুন্ধরা, সিদ্ধেশ্বরী, কারওয়ান বাজার, বনশ্রী, বিজয়নগর, ওয়ারী, সেগুনবাগিচা, নিকুঞ্জ এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলশী আগ্রাবাদ ও নাসিরাবাদ এলাকায় অপ্রদর্শিত অর্থের ক্ষেত্রে ২০০ বর্গমিটারের কম আয়তনের ফ্ল্যাটের কর বর্গমিটারপ্রতি ৩ হাজার টাকা ও বড় ফ্ল্যাটের কর প্রতি বর্গমিটারে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এসব এলাকার কর পাঁচগুণ বাড়তে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা।
এর বাইরে অন্যান্য এলাকার কর বর্তমানে প্রতি বর্গমিটারের জন্য ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা; এগুলোর কর বাড়তে পারে তিনগুণ। ধরা যাক, গুলশান এলাকায় কেউ ২০০ বর্গমিটার আয়তনের অ্যাপার্টমেন্ট কিনবেন কালো টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে। তাহলে বর্তমান হিসাবে কর আসবে ৮ লাখ টাকা। পাঁচগুণ বাড়ানোর পর কর দিতে হবে ৪০ লাখ টাকা।
রিহ্যাব সহ-সভাপতি এমএ আউয়াল বলেন, ঢালাওভাবে কর বাড়ানো হলে এবং শর্ত কঠোর করা হলে আবাসন খাত একদম মুখ থুবড়ে পড়বে। এত টাকা কর দিয়ে কেউ এপার্টমেন্ট কিনতে চাইবেন না। সার্বিক বিষয়ে শিগগিরই গণমাধম্যের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।