
সাংগঠনিক দুর্বলতা , কোন্দলের কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ( রাকসু ) নির্বাচনেও ভরাডুবি হলো ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের । উল্টো দিকে বড় জয় পেয়েছে ছাত্রশিবির । কেন্দ্রীয় সংসদের ২৩ পদের মধ্যে সহসভাপতিসহ ( ভিপি ) ২০ পদে জিতেছে তাদের প্রার্থীরা । সিনেট ও হল সংসদেও শিবিরের আধিপত্য । ডাকসু , জাকসু ও চাকসুর মতো রাকসুতেও নিরঙ্কুশ জয় শিবিরের । দীর্ঘ ৩৫ বছর পর গত বৃহস্পতিবার রাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর রাত থেকে ফল ঘোষণা শুরু হয় ।
পূর্ণাঙ্গ ফল আসে গতকাল শুক্রবার সকালে । ফল বিশ্লেষণে দেখা যায় , ১৭ টি আবাসিক হলে ভোট পড়েছে ২০ হাজার ১৮৭ টি । এর মধ্যে শিবির - সমর্থিত সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ পেয়েছেন ১২ হাজার ৫৮৭ ভোট । ছাত্রদল - সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবির পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৯৭ ভোট । জিএস ( সাধারণ সম্পাদক ) পদে বিজয়ী সালাহউদ্দিন আম্মার পেয়েছেন ১১ হাজার ৪৩৭ ভোট । বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এই সমন্বয়ক স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন । শিবিরের প্যানেল থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন । আরেক সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা । তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৭২৯ ভোট । এজিএস পদে শিবিরের এস এম সালমান সাব্বির ৬ হাজার ৯৭১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন । ছাত্রদলের জাহিন বিশ্বাস এযা ৫ হাজার ৯৪১ ভোট পেয়ে তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছেন । কেন্দ্রীয় সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয় নারী ফুটবলার নার্গিস খাতুন । ছাত্রদল- সমর্থিত প্যানেল থেকে তিনিই একমাত্র নির্বাচিত প্রার্থী । আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ তোফা । কেন্দ্রীয় সংসদের অন্য সব পদে বিজয়ী শিবির - সমর্থিত জোটের প্রার্থীরা । এদিকে সিনেট ছাত্র প্রতিনিধির পাঁচটি পদের মধ্যে তিনটিই শিবিরের । হল সংসদগুলোতেও শিবিরের আধিপত্য । বেশির ভাগ পদে শিবিরের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ।
ছাত্রদলের ভরাডুবির নেপথ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই ছিল ছাত্রশিবিরের আধিপত্য । তবে এ নির্বাচনে শিবিরের প্রার্থী বাছাইয়ে মুনশিয়ানা, ক্যাম্পাসের চারপাশে জামায়াত - শিবিরের প্রভাব ও পরিকল্পিত প্রচারণা তাদের বড় জয় এনে দিয়েছে । এর বিপরীতে ছাত্রদলের ভেতরেই বিশৃঙ্খলা ও তুলনামূলক ' দুর্বল ' প্রার্থী তাদের ভরাডুবির কারণ বলে শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করছেন ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমবার বিতাড়িত হয়ে ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসের চারপাশে অবস্থান নিয়ে সেদিকে শক্ত বলয় তৈরি করেছে । আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থীই হলের বাইরে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় থাকেন । ক্যাম্পাসের বাইরে এসব শিক্ষার্থীর কাছেই প্রচারণা চালিয়েছে শুধু জামায়াত - শিবির ।
উল্টো দিকে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে রাবি ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে , তিনি তাঁর একার অনুসারী খুঁজেছেন । অন্য পদগুলোতেও কে কার অনুসারী তা প্রার্থিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে । এ নিয়ে সংগঠনেই বিশৃঙ্খলা ছিল । জিএসকে নিয়ে
আলোচনা :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শুধু স্লোগান দিয়ে সবার নজরে আসেন সালাহউদ্দিন আম্মার । এরপর পোষ্য কোটাবিরোধী আন্দোলন , এ আন্দোলনে শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগ , জুলাই কনসার্টের নামে চাঁদা চেয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়াসহ নানা ঘটনায় আলোচিত- সমালোচিত তিনি । তবে তিনি জিএস ও সিনেট প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন । শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বলছেন , কৌশলে প্যানেলের প্রার্থীকে পরাজিত করে আম্মারকে বিজয়ী করেছেন শিবিরের নেতা - কর্মীরাই । এ কারণে শিবিরের প্রার্থী জিএস পদে পরাজিত হলেও সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন । এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দুয়েকজনকে স্ট্যাটাস দিতে দেখা গেছে । যদিও সালাহউদ্দিন আম্মার এ কথা অস্বীকার করছেন । বলেছেন , “আমি কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনে যুক্ত নই । ” আগে অবশ্য আম্মার স্বীকার করেছেন , জুলাই-আগস্টের উত্তাল সময়ে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি ছাত্রশিবিরেরই শেল্টারে লুকিয়ে থাকতেন গোপন স্থানে । আবার নিজেই তিনি বলেছেন , “আম্মার আব্বু জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত । আমি পড়েছি জামায়াতের প্রতিষ্ঠান তামীরুল মিল্লাতে । আমি এটা ওন করি । ছাত্রশিবিরের রিয়েলিটি শোতে ২০২৩ - এ জাতীয় পর্যায়ে আমি চ্যাম্পিয়ন ছিলাম । তামীরুল মিল্লাতের প্রত্যেকটা প্রোগ্রামের ব্যানার ছাত্রশিবিরেরই হয় । ছাত্রশিবির হয় তিন ধরনের । এনভায়রনমেন্টাল শিবির, সিচুয়েশনাল শিবির ও এডুকেশনাল শিবির । আমি হচ্ছি এনভায়রনমেন্টাল শিবির । আমি তামীরুল মিল্লাত ও পরিবার থেকে শিবিরের এনভায়রনমেন্টটা পেয়েছি । সেটা বলতে পারেন । ' কাজ করতে চান একসঙ্গে : ভোটের পর গতকাল শুক্রবার সকালে ক্যাম্পাস একেবারেই সুনসান দেখা গেছে । পরিবহন মার্কেটে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন । কথা হয় পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবরিনা আফরোজের সঙ্গে ।
তিনি বলেন , ‘ প্রার্থীরা বড় বড় ইশতেহার দিয়েছেন । বিজয়ের পর তার আংশিক হলেও আমরা বাস্তবায়ন চাই । আর রাকসু যেন নিয়মিত হয় , এটাই প্রত্যাশা । ” শিক্ষার্থীদের এমন আকাঙ্ক্ষার বিষয় নিয়েই ফল ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে কথা বলেছেন নবনির্বাচিত ভিপি ও জিএস । ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন , ‘ আমরা দীর্ঘ বছর রাকসু বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করেছি । আজ সেই রাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন । এখানে বিজয়ী প্রার্থীর তুলনায় বিজিতের সংখ্যা বেশি । আমরা সবাই মিলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করে যাব । ’ জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারও বললেন , ‘ সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এসেছে । আমরা এক হয়ে কাজ করব । আমাদের পরিচয় হবে ভিপি , জিএস - এজিএস এভাবে । কোনো দলীয় পরিচয় নয় । '