Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য থামছেই না। অব্যাহতভাবে ধর্ষণের হুমকি, অশ্লীল ছবি বানিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ডাকসুর প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই এসব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে উমামা ফাতেমা, ফাতেমা তাসনিম জুমা, উম্মে সালমা সাবিকুন্নাহার তামান্না, ইসরাত জাহান ইমু, আফসানা আক্তার, ফারিয়া মতিনসহ বিভিন্ন প্যানেলের নারী প্রার্থীদের। সাধারণভাবে সব প্রার্থীদেরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোর মন্তব্য বাক্সে গালাগাল সহ্য করতে হচ্ছে। কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যকারীরা থেমে নেই নারীদের ইনবক্সেও। সেখানেও নানা মন্তব্য করে যৌন হেনস্তা করা হচ্ছে। মানসিক নিপীড়নের শিকার করা হচ্ছে নারী প্রার্থীদের। ফলে ভেঙে পড়েছেন অনেক নারী। রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে তারা বেশ হতাশাপূর্ণ অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি নারীদের প্রোফাইল থেকে ছবি নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কুরুচিপূর্ণ ছবি নির্মাণ করা হচ্ছে, যা বিভিন্ন পেজ থেকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে নারীদের এমন ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে- কতোটা নিরাপদ নারী প্রার্থীরা?

ডাকসু নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের জিএস প্রার্থীর বিরুদ্ধে রিটকারী এক বাম নেত্রীকে গণধর্ষণের হুমকি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেত্রীদের হেনস্তা এবং নারী শিক্ষার্থীদের ওপর অব্যাহত সাইবার বুলিংয়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রদল। মঙ্গলবার দুপুরে টিএসসি থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ শেষে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয় তারা। এ সময় ছাত্রদল নেতাকর্মীরা নারী নির্যাতন, মৌলবাদ ও ডাকসু বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন।
সমাবেশে ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ৫ই আগস্ট পরবর্তী নারী শিক্ষার্থীদের বারবার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে। চলাফেরার স্বাধীনতা, পোশাকের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা চরমভাবে হরণ করা হয়েছে। নারী শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণের হুমকি দেয়া কুলাঙ্গার আলী হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা প্রশাসন নেয়নি। সে এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা কি সুস্থ সমাজ হতে পারে? অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই কুলাঙ্গারকে গ্রেপ্তার করে তাকে একাডেমিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই। এই ক্যাম্পাসে আমার বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছাত্রদল বদ্ধপরিকর। তিনি আরও বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য ছাত্রদলের প্রার্থীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে অনলাইন-অফলাইনে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। আপনারা সতর্ক থাকবেন। ডাকসু নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আলী হোসেন। তিনি রিটকারী বাম নেত্রী বিএম ফাহমিদা আলমকে গণধর্ষণের পদযাত্রা করতে চেয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন। আলী হোসেনকে শিবিরের নেতা আখ্যা দিয়ে ছাত্রদলের অভিযোগের প্রতিবাদে রাজধানীর প্রেস ক্লাব থেকে বিক্ষোভ করেছে ছাত্রশিবির। তারা অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, ছাত্রদলের বক্তব্য ভিত্তিহীন, মনগড়া ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আলোচনা-সমালোচনার মুখে ফেসবুক লাইভে এসে অভিযুক্ত আলী হোসেন বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। নিজের অপরাধ অস্বীকার না করলেও অভিযোগ করেন, তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিবিরের সঙ্গে জড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
গত সোমবার এক নারী প্রার্থী ডাকসু নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের জিএস পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে রিট করেন। রায়ে ডাকসু স্থগিত হয়, পরে চেম্বার জজ আদালত আদেশ স্থগিত করলে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের আলী হোসেন নামে শিক্ষার্থী রিটকারী ফাহমিদাকে ‘গণধর্ষণ’র হুমকি দেন। ছাত্রদলসহ অন্যদের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হলেও কোনো প্রমাণ মেলেনি।

এদিকে, শুধুমাত্র শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের পক্ষে নির্বাচনে যাওয়ায় প্রায় ৬৯৩ বার ধর্ষণ এবং সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পাদক প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমা। একই ধরনের হুমকি এবং অনলাইন সহিংসতার শিকার একই প্যানেলের আরেক প্রার্থী উম্মে সালমা। এসব মন্তব্যকারীরা ছাত্রশিবিরের মতবিরোধের কারণে এবং তাদের প্যানেলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় এই দুই প্রার্থীর ওপর খড়গহস্ত হয়েছে বিরোধী মতের লোকজন।

এদিকে, এক সংবাদ সম্মেলনে জুমা এবং উম্মে সালমার ওপর হওয়া প্রতিটি ঘটনার স্ক্রিনশট প্রিন্ট করে এনে সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন শিবির মনোনীত জিএস প্রার্থী এসএম ফরহাদ। তিনি একে একে এই দুই প্রার্থীর ওপর হওয়া কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সাংবাদিকদের দেখান এবং কয়েকটি পড়েও শোনান। তিনি সরাসরি এসবের জন্য ছাত্রদলের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের দোষারোপ করেন। একই রকম সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন বাম প্যানেলের ইসরাত জাহান ইমু, ফারিয়া মতিন, নুজিয়া হাসিন রাশাসহ কয়েকজন নারী প্রার্থী।

এ বিষয়ে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা মানবজমিনকে বলেন, এটা প্রশাসনের ব্যর্থতা। প্রশাসনের উচিত ছিল নারীদের এসব সাইবার বুলিং এবং হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে কাজ করা। কিন্তু প্রশাসন সেটা করতে পারেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমার সঙ্গেও এসব হয়ে আসছে বহুদিন ধরে, কিছু বলার নাই।

ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী উম্মে সালমা বলেন, যেদিন থেকে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলে অংশগ্রহণ করেছি, সেদিন থেকে নানাভাবে নানা রকম কথা শোনানো হচ্ছে, আমাদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হচ্ছে। আমাকে বিভিন্ন রকম অ্যাঙ্গেলে বিভিন্ন রকমভাবে কথা বলা হচ্ছে। এগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রদল-বিএনপি সমর্থিত বিভিন্ন নেতাকর্মীরা করছে। আইডিগুলোতে তাদের বিভিন্ন পদবি সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

‘গণধর্ষণের’ হুমকির ঘটনা তদন্তে দুই কমিটি
ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টে রিট করা এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের হুমকি দেয়ার ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কার্যালয় তিন সদস্যের এবং ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন কমিশন দুই সদস্যের তথ্যানুসন্ধান কমিটি করেছে। মঙ্গলবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর কার্যালয় ৩ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ তদন্ত কমিটিতে সহকারী প্রক্টর মুহাম্মদ মাহবুব কায়সারকে আহ্বায়ক এবং সহকারী প্রক্টর শেহরীন আমিন ভূঁইয়া ও মো. রেজাউল করিম সোহাগকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। একই ঘটনা তদন্তে দুই সদস্যের আরেকটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি করেছে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন কমিশন। এই কমিটিতে রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক কাজী মোস্তাক গাউসুল হককে আহ্বায়ক এবং সহকারী প্রক্টর জাহাঙ্গীর আলমকে সদস্য করা হয়েছে। তাদের আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।