
ফিলিস্তিনিদের দুর্ভিক্ষের কিনারায় ঠেলে দেওয়ার পর এবার গাজার পানির সরবরাহকে ‘যুদ্ধাস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল। ইচ্ছাকৃতভাবে পানির প্রবাহ সীমিত করে প্রায় ১২ লাখ মানুষকে গাজা সিটি থেকে উৎখাত করার কৌশল নিয়েছে তেল আবিব।
শুক্রবার (২২ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে আনাদোলু এজেন্সি।
গাজার পানির নেটওয়ার্ক কার্যত ভেঙে পড়েছে। বহু কূপ ধ্বংস হয়েছে, একমাত্র লবণাক্ত পানি শোধনাগার যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই অচল, আর সাধারণ পরিবারগুলো এখন মূলত ইসরাইলি নিয়ন্ত্রিত মেকোরোট পাইপলাইনের অল্প সরবরাহের ওপর বেঁচে আছে।
ইসরাইলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে, সরকার উত্তর গাজার পানির প্রবাহ কমানোর পরিকল্পনা করছে, একই সঙ্গে দক্ষিণে পাইপলাইন পুনঃস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে—যা ব্যাপকভাবে স্থানীয়দের দক্ষিণমুখী করতে একপ্রকার জোরপূর্বক চাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর মধ্যে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ নতুন সামরিক অভিযানের অনুমোদন দিয়েছেন। ‘গিডিওনস চারিয়টস ২’ নামের এ অভিযানের লক্ষ্য গাজা সিটিতে হামলা চালিয়ে সেখানকার জনগণকে উচ্ছেদ করা।
গাজার পানিসংকট ও ধ্বংসস্তূপ
গাজার পৌরসভার মুখপাত্র হোসনি মুহান্না আনাদোলুকে বলেছেন, ‘৫৬টি কূপ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকগুলো বন্ধ হয়ে আছে।’
তিনি জানান, গাজার ৭৫ শতাংশের বেশি কূপ, পাম্প স্টেশন ও শোধনাগার অকার্যকর হয়ে গেছে। এখন মেকোরোট পাইপলাইন থেকে ৭০ শতাংশ পানি আসছে, বাকি চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ পূরণ করছে কিছু বেঁচে থাকা কূপ।
মুহান্নার মতে, মাথাপিছু পানির প্রাপ্যতা নেমে এসেছে দৈনিক মাত্র ৫ লিটারে, যেখানে বৈশ্বিক ন্যূনতম মান ১০০ লিটার। এ অবস্থায় ১২ লাখের বেশি বাসিন্দা ও বাস্তুচ্যুত মানুষ তৃষ্ণাজনিত মহামারির ঝুঁকিতে পড়েছেন।
চাপ ও হুমকি
শুক্রবার ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বন্দিদের মুক্তি ও অস্ত্র জমা না দিলে গাজার ওপর ‘নরকের দরজা’ খুলে দেওয়া হবে।
অন্যদিকে গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজা পুনর্দখলের এই পরিকল্পনা কার্যত ‘১২ লাখ মানুষের জন্য মৃত্যুদণ্ড ও গণউচ্ছেদ আদেশ—যা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সমাজকে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।
পানিকে অস্ত্রে পরিণত করা
পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মেকোরোট পাইপলাইন নিজেও হামলার সময় বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সরবরাহ অস্থির হয়ে পড়ে।
মুহান্না সতর্ক করে বলেছেন, ‘আরও কোনো কাটছাঁট হলে গাজার পানি সরবরাহ পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। লাখো পরিবার ন্যূনতম বেঁচে থাকার পানিও পাবে না।’ তিনি জাতিসংঘ ও রেডক্রসকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান, যাতে ইসরাইল পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করে।
গাজার পুনর্দখল পরিকল্পনা ও ভয়াবহ প্রাণহানি
ইসরাইলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা এ মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ধাপে ধাপে গাজা পুনর্দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এতে প্রথম ধাপে গাজা সিটির বাসিন্দাদের জোরপূর্বক দক্ষিণে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় আট লাখ ফিলিস্তিনিকে তথাকথিত ‘মানবিক অঞ্চলে’ স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যেখানে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র, ফিল্ড হাসপাতাল ও পানির সুবিধা স্থাপন করা হবে।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৬২ হাজার ১০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো উপত্যকা, চলছে দুর্ভিক্ষ।
এরই মধ্যে গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পাশাপাশি গাজায় নৃশংস সামরিক অভিযানের কারণে ইসরাইলকে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মুখোমুখি।