
জমে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তৎপরতা। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রায় সবারই প্যানেল দেয়া শেষ। এবারের মতো এত বেশি নারী প্রার্থী দেখা যায়নি অতীতে। শীর্ষ পদ তো বটেই, সম্পাদকীয় পদেও নারীরা আছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র দু’জন নারী ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম নারী ভিপি ছিলেন বেগম জাহানারা আক্তার। তিনি ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচনে এ পদে নির্বাচিত হন। এরপর দ্বিতীয় নারী হিসেবে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে ভিপি নির্বাচিত হন মাহফুজা খানম। দীর্ঘ ৫৮ বছর আর কোনো নারীকে ভিপি পদে দেখতে পায়নি ডাকসু।
প্যানেল দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সম্মানজনক স্থান দেয়ার চেষ্টা ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের মাঝে। ১৫ই জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে আহত সানজিদা আহমেদ তন্বীর প্রতি বিশেষ সম্মান জানিয়ে উভয় সংগঠনই ডাকসু’র গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদ খালি রেখেছেন। উভয় সংগঠনের এমন কাজ প্রশংসা কুড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের। সব মিলিয়ে কেবল প্যানেলের বিচারেই অন্তত ২৫ জন নারী ডাকসুতে বিভিন্ন পদে লড়তে যাচ্ছেন ।
সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)- এই তিন শীর্ষ পদে পাঁচজন নারী শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তার জনপ্রিয়তাও রয়েছে ব্যাপক, বিশেষত নারীদের মাঝে। আন্দোলনের সময় নারী শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে তার অবদান প্রশংসিত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে অভ্যুত্থানের পর ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব পদ থেকে এবং পরবর্তীতে বৈষম্যবিরোধীর সব দায়িত্ব থেকেও পদত্যাগ করেন। দলীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে স্বতন্ত্র প্যানেল গঠন করেন উমামা। তার প্যানেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া এবং বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দীন মুজাহিদ মাহিকে জিএস এবং এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা চলছে।
এদিকে আরেক ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। এবার তিনি বাম জোটের প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল থেকে প্রার্থী হয়ে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে হয়েছেন বিতর্কিত। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ডাকসুর আজীবন সদস্য দেখতে চাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন এক অনুষ্ঠানে। এ নিয়ে তার সমালোচনা করছেন অনেকে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের প্যানেল থেকে সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন আশরেফা খাতুন। তিনি ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্পাদকীয় পদে সর্বোচ্চসংখ্যক নারী প্রার্থী আছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর প্যানেলে। সম্পাদকীয় পদে ১১ জন নারী আছেন। তারা হলেন নূজিয়া হাসিন (রাশা) কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ফারিয়া মতিন (ইলা) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, মালিহা তাবাসসুম ক্রীড়া সম্পাদক, ফিন্যান্স বিভাগ, শেখ তাসনুভা সৃষ্টি স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ ।
কার্যকরী সদস্য পদে প্রার্থী হচ্ছেন, মিশকাতুল মাশিয়াত তানিশা, আতিকা আনজুম অর্থী, ইসরাত জাহান ইমু, আনিয়া ফাহমিন, রাহনুমা আহমেদ নিরেট, হেমা চাকমা, নোশিন হুমায়রা সদস্য ও সম্পাদকীয় মিলে ৪ জন আছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেলে। কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ক্যাম্পাস এক্টিভিস্ট উম্মে সালমা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ফাতিমা তাসনীম জুমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রীসংস্থার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাবিকুন্নাহার তামান্না ও আফসানা আক্তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সদস্য পদে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) প্যানেলে আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক আনিকা তাহসিনা, কমনরুম ও ক্যাফেটরিয়া সম্পাদক মিতু আক্তার, সদস্য পদে তাপসী রাবেয়া, রওনক জাহান ও মাহফুজা নওয়ার নওরীন।
ছাত্রদলের প্যানেলে দু’জন নারী পেয়েছেন স্থান । চেমন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কমনরুম, পাঠকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদে, সদস্য পদে মেহেরুন্নেসা কেয়া।
২৮ পদের বিপরীতে মনোনয়ন জমা পড়লো ৫০৯টি: ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমাদানের নির্ধারিত সময় শেষ হয়েছে। এতে ২৮টি পদের বিপরীতে ৫০৯টি ফরম জমা পড়েছে। বিতরণকৃত ফরমের মধ্যে ১৪৯টি ফরম জমা পড়েনি। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত ১২টি হলের হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৬৮৯ জন প্রার্থী। বুধবার (২০শে আগস্ট) বিকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
এদিকে হল সংসদে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৬২টি, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৬৫, জহুরুল হক হলে ৮০, মুহসিন হলে ৬৪, শামছুন্নাহার হলে ৩৬, জিয়াউর রহমান হলে ৭৮, শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৬৮, সুফিয়া কামাল হলে ৪০, কুয়েত মৈত্রী হলে ৩১, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩৬, বিজয় একাত্তর হলে ৬৭, এফ রহমান হলে ৬৭টি জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, এ পর্যন্ত মোট ৫০৯টি মনোনয়ন ফরম জমা পড়েছে, ১৪৯টি ফরম জমা পড়েনি। এখন পর্যন্ত ১২টি হলের হিসাব পাওয়া গেছে। ডাকসু ইলেকশন রিটার্নিং অফিসার কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের দিন, এর আগের দিন এবং পরেরদিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছি।
ডাকসু’র তফসিল অনুযায়ী, গত ১২ই আগস্ট থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হয় যা ১৮ই আগস্টে শেষ হবার কথা থাকলেও পরে একদিন বৃদ্ধি করে ১৯শে আগস্ট করা হয়। মনোনয়ন জমাদানের শেষ সময়ও ১ দিন বাড়িয়ে ২০শে আগস্ট করা হয়। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের শেষদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদে ১০টি প্যানেল ও স্বতন্ত্রভাবে মোট মনোনয়ন নিয়েছেন ৬৫৮ জন এবং ১৭টি হল সংসদে মনোনয়ন বিক্রি হয়েছে ১৪২৭টি। যাচাই-বাছাই শেষে ২১শে আগস্ট বেলা একটায় চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে।
মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ২০শে আগস্ট এবং ২১শে আগস্ট প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ২৫শে আগস্ট মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ২৬শে আগস্ট চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে ৯ই সেপ্টেম্বর এবং সেদিনই ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এবারই প্রথমবারের মতো হলের বাইরে ছয়টি কেন্দ্রে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ইতিমধ্যে ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকায় মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। এরমধ্যে ছাত্র ভোটার ২০ হাজার ৮৭১ জন ও ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯০২ জন।