সরকারে যোগদানের পর গত চার দিন ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেছেন, সরকারে বসে শুধু বিবৃতি দেওয়া নয়, কাজ করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। তবে এখন মনে হচ্ছে, ‘ফর দ্য রেকর্ড’ কয়েকটি প্রসঙ্গে কথা বলা উচিত।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি এসব কথা লেখেন।
আবুল সরকার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে: আবুল সরকারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে-এটি জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন সেখান থেকে তাঁকে একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠানো হয় এবং পরিস্থিতির উত্তাপ ও ঝুঁকির দিকগুলো ব্যাখ্যা করা হয়। তিনি বুঝতে পারেন, পুরো ব্যাপারটি একটি সংকটের দিকে যাচ্ছে। ফারুকী বলেন, যেকোনো ফৌজদারি অপরাধে পদক্ষেপ নেওয়ার মূল দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তিনি তাঁর পক্ষ থেকে যা বলার বা করার, তা করেছেন এবং বলছেন। এর বেশি তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির ক্ষেত্রে তাঁর বা তাঁর মন্ত্রণালয়ের কোনো বিশেষ ক্ষমতা নেই। এ-সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এই সংবেদনশীল বিষয়টি পরিচালনা করছে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সবাইকে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ করেন। তাঁর মতে, ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রীতিই দেশকে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে; অন্য কিছু কেবল ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।
সমালোচনার প্যাটার্ন: তিনি বলেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমালোচনার কিছু আকর্ষণীয় প্যাটার্ন লক্ষ্য করছেন। কোনো সমালোচনার লক্ষ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়-লক্ষ্য ফারুকী। এদের মধ্যে কয়েকজনকে তিনি চেনেন, যারা কমন সার্কেলের আড্ডায় বলেছেন, ফারুকীর মন্ত্রণালয় যে ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে তা দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি অনুমান করেন, সেই প্রসঙ্গে ঘটে যাওয়া আবুল সরকারের ঘটনা এখন তাঁর ওপর আক্রমণ হিসেবে ফিরছে। ফারুকী তাদের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে বলেন, এই কাজটা তাঁকে করতেই হবে। শহীদরা তাঁকে এই কাজ করতে পাঠিয়েছে। তিনি ক্ষমা চান, যদি এটি তাদের অস্বস্তিকর করে তোলে। সামনে তাঁর মন্ত্রণালয় আরও অস্বস্তিকর কাজে হাত দেবে। তাঁর মতে, ইতিহাসকে মুছে ফেলা বা নির্বাচিত অংশ প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ বানানোর প্রচেষ্টা বহু বছর ধরে চলেছে। একদল তরুণ গবেষক এখন সেই প্রকল্প যাচাই-বাছাই করছে। ফলে তাঁকে আরও আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
বাউল ও লালন প্রসঙ্গ: সমালোচনার আরেকটি প্যাটার্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় লালনকে সেলিব্রেট করে, আর বাউল মারছে! ভণ্ডামি!’ তিনি বুঝতে পারেন না, বাউলকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কী মারল? তিনি তাদের একটু গবেষণা করতে বলেন। দেখবেন, ফকির-বাউলের ওপর আক্রমণের ইতিহাস অনেক পুরনো। এমনকি আওয়ামী লীগের আমলেও অনেক স্থানে বাউলদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, চুল কেটে দেওয়া হয়েছে, বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে পালাকারও গ্রেপ্তার হয়েছে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে সর্বোচ্চ যা সম্ভব, তাই করা হয়েছে-লালনকে জাতীয়ভাবে সেলিব্রেট করার সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে তারা তাদের পাশে আছেন। লালন শাহ একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক-কবি-দার্শনিক। এছাড়া সারাদেশে তারা বহু সাধুসঙ্গ করেছেন। তারা পরিষ্কারভাবে বহুত্বের পক্ষে সांস্কৃতিক অবস্থান নিয়েছেন। ৫৪ বছরে প্রথমবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ঈদ, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, দুর্গাপূজা সেলিব্রেট করেছে। নববর্ষে সকল জাতিগোষ্ঠীকে একত্রে উৎসব করেছেন। এটি হলো নতুন বাংলাদেশের ছবি, যেখানে সকল জনগোষ্ঠীর অংশ থাকবে।
সরকারের করণীয়: তিনি প্রশ্ন তোলেন, সরকারের করণীয় কী? ধরুন, কোথাও মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ হলো। তাদের করণীয় কী হবে? তাঁর মনে হয়, যারা এটি করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা এবং খেলার সংখ্যা বৃদ্ধি করা। নাকি খেলা বন্ধ হওয়ায় মেয়েদের সব খেলাই বন্ধ করা উচিত? লালনকে জাতীয়ভাবে পালন করা এবং সরকারি উদ্যোগে সাধুসঙ্গ বৃদ্ধি করা কীভাবে অপরাধ হলো, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
ড্রোন শো নিয়ে তামাশা: সবচেয়ে তামাশাময় বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাউলরা আক্রান্ত হয়েছে, ড্রোন শো করতে বলো ফারুকীকে? আমেনার মা রিকশা থেকে পড়ে গেছে? ফারুকীকে বলো, আরও ড্রোন শো করুক। হাহাহাহা, খুব মজার। ভাই ও বোনেরা, টেলিভিশনের আমিন চেয়ারম্যান হবেন না, প্লিজ।’ তাঁর বন্ধু ডরোথি ওয়েনার টেলিভিশন দেখে তাঁকে বলেছিলেন, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় হলো ‘ফিয়ার অফ দ্য আননোন’।’ তাই ড্রোন শো তাদের কাছে সেই ‘আননোন থিং’। বিশ্বজুড়ে বড় ইভেন্টে এখন ড্রোন শো যুক্ত হচ্ছে। নতুন বছর, জাতীয় দিবস, পূজা, কালচারাল ফেস্টিভ্যাল-এগুলোতে ড্রোন শো এখন নতুন নিয়ম। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে এবং আরও হবে।