এই বছর জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—জার্মানির সেনাবাহিনীকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার। বহু বছর অবহেলায় থাকা এক সেনাবাহিনীর জন্য এ লক্ষ্য অনেকটাই উচ্চাশার মতো।
দেশটির সরকার আশাবাদী, সর্বসম্মত একটি খসড়া বিল এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথে সহায়ক হবে। এই বিলের লক্ষ্য, রাশিয়ার সম্ভাব্য হুমকি ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে জার্মান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা।
নতুন সংস্কারের অংশ হিসেবে ২০৩৫ সালের মধ্যে সেনাসদস্যের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর সঙ্গে আরও ২ লাখ রিজার্ভ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
প্রথম ধাপে, এটি থাকবে স্বেচ্ছাসেবীভিত্তিক। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনাও থাকবে—প্রাথমিক বেতন ধরা হয়েছে মাসে ২ হাজার ৬০০ ইউরো, যা বর্তমানের তুলনায় ৪৫০ ইউরো বেশি।
যদি এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হয়, তবে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক সেনা ডাক চালু করতে পারবে।
২০২৫ সাল থেকে ১৮ বছর বয়সী সব তরুণকে একটি প্রশ্নপত্র পাঠানো হবে, যাতে সেনাবাহিনীতে যোগদানে তাদের আগ্রহ জানা যাবে। পুরুষদের জন্য এটি পূরণ করা বাধ্যতামূলক হবে। ২০২৭ সাল থেকে পুরুষদের শারীরিক পরীক্ষাও বাধ্যতামূলক হবে।
এই পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে নিরাপত্তার চাপ। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইউরোপকে নিজের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই, আর বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রাশিয়া ভবিষ্যতে ন্যাটোর কোনো সদস্য দেশেও আক্রমণ করতে পারে।
জার্মানির প্রতিরক্ষা প্রধান জেনারেল কার্সটেন ব্রুয়ের মনে করেন, ২০২৯ সালের মধ্যেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে সরাসরি হুমকি আসতে পারে।
সেনাসংখ্যা বাড়ানো নিয়ে কোয়ালিশন সরকারে কিছুটা মতভেদ ছিল। প্রস্তাব এসেছিল লটারির মাধ্যমে কাউকে ডাক দিয়ে সেনাবাহিনীতে নেওয়ার। কিন্তু প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়ুস এই প্রস্তাব বাতিল করে দেন এবং বলেন, আর্থিক উৎসাহের মাধ্যমেই সেনা সংগ্রহের পথ অনুসরণ করা হবে।
২০১১ সালে জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সেনাসেবা বন্ধ হয়। এরপর থেকে সেনাবাহিনী স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর নির্ভর করছে।
প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে। অনুমোদন মিললে ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হবে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিস্তোরিয়ুস বলেন, ‘‘আতঙ্কের কিছু নেই। কারণ ইতিহাস বলে, প্রতিরোধ ও আত্মরক্ষায় সেনাবাহিনী যত বেশি প্রস্তুত থাকবে, যুদ্ধ এড়ানোর সম্ভাবনাও তত বেশি থাকবে।’’
তিনি আশাবাদী, এই মডেল ইউরোপের অন্য দেশগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করবে।
তবে এই পরিকল্পনা ঘিরে মতভেদ স্পষ্ট। বিশেষ করে বামপন্থী রাজনীতিক ও তরুণদের অনেকে বাধ্যতামূলক সেনাসেবা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।
অনেকে বলছেন, এটি তাদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কথা বলছেন অনেকেই।
তথ্য বলছে, চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত ৩ হাজারের বেশি মানুষ ‘অন্তরাত্মার আপত্তি’র (conscientious objection) আবেদন করেছেন, যা ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ।
শীতল যুদ্ধের পর জার্মান সেনাবাহিনী বছরের পর বছর অবহেলিত ছিল। বাজেট ছিল কম, হুমকির অনুভব ছিল না। নাৎসি ইতিহাসের ছায়ায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাব সমাজে গভীরভাবে গেঁথে ছিল।
কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে।
তৎকালীন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ একে বলেছিলেন ‘জাইটেনভেন্ডে’ বা ‘পরিবর্তনের যুগ’। সেদিনই ১০০ বিলিয়ন ইউরোর একটি বিশেষ তহবিল বরাদ্দ দেওয়া হয় সেনাবাহিনী আধুনিকায়নে।
এ বছর জুনে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভেটারান্স ডে’ পালন করেছে।
চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস দায়িত্ব নেওয়ার পর এই মনোভাব আরও দৃঢ় হয়েছে। তিনি ঘোষণা দেন, জার্মান সেনাবাহিনী হবে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী।
তিনি বলেন, ‘‘পুতিন কেবল শক্তির ভাষাই বোঝে।’’