বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, গ্রিক কবি হোমার, মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি, বিজ্ঞানী টমাস এডিসন, ইংরেজি সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার প্রত্যেকেরই ছেলেবেলায় স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। পরবর্তীতে তারা নিজের চেষ্টায় স্মৃতিশক্তিকে প্রখর করেছিলেন। আমাদের চারপাশের অনেকেই স্মৃতিশক্তির দুর্বলতায় ভোগেন। এই স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর কিছু আধুনিক কৌশল রয়েছে।
স্মৃতি ও বিস্মৃতি
স্মৃতি ও বিস্মৃতির ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান একমত। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন- ভালো বা দুর্বল স্মৃতিশক্তি মানুষের জন্মগত ব্যাপার। আবার সাথে সাথে এও বলেন, সুন্দর পরিবেশের প্রভাবে এর উন্নয়ন সম্ভব। মনোবিদ জেমস স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে বলেন- এটি মানুষের জন্মগত ক্ষমতা, স্মৃতি মানসিক নয়, দৈহিক বিষয়। মস্তিষ্ক ও স্নায়ু পথের পুনর্গঠনে উৎপন্ন হয় স্মৃতি। তবে তিনি এও বলেন, মনোযোগ ও অনুরাগ বৃদ্ধি করে বিষয়বস্তুকে দ্রুত আয়ত্ত করা যায়। মনোবিজ্ঞানী স্টাউডের ভাষায়, 'অনুশীলনের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তির উন্নয়ন সম্ভব।' এভাবে ফ্রয়েড, স্যামন, এনগ্রাম, হেব, মরগ্যান, রবিনসন প্রমুখ বিখ্যাত মমোবিদরা স্মৃতিকে মানুষের জন্মগত ক্ষমতা বলে উল্লেখ করেছেন, আবার একই সাথে এর উন্নয়নের বিভিন্ন পথও দেখিয়েছেন।
আমরা কেন ভুলে যাই?
পরীক্ষার হলে অনেকেরই মুখস্থ পড়া মনে থাকে না। আবার নিজ হাতে কোন জিনিস রেখে আমরা সেটাও ভুলে যাই অনেকেই। আমাদের সবারই কমবেশি ভুলে যাওয়ার স্বভাব রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সময় পার হবার পর কাজটি করার কথা মনে হয়।
এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানীদের মতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা যা ঘটে, বিস্মৃতির জন্য সেসব ঘটনাও দায়ী। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- পর্যালোচনার অভাব, পশ্চাৎমুখী বাঁধা, আঘাত, পারিপার্শ্বিক পরিবর্তন, আবেগজনিত প্রতিরোধ, মনোযোগ ও অনুরাগের অভাব, দেহ ও মনের অসুস্থতা ইত্যাদি।
স্মৃতি ও কল্পনা
কোনো একটি বস্তু প্রত্যক্ষ করার পর যখন স্মরণ ক্রিয়ার সাহায্যে তারই একটি প্রতিচ্ছবি আমাদের মানস ক্রিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়, তখন তাকে বলা হয় স্মৃতি। আর অতীত অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে, নতুনভাবে তাকে সাজিয়ে যখন একটি নতুন চিত্র রচনা করা হয়, তখন তাকে বলা হয় কল্পনা।
স্মৃতিকে কীভাবে উন্নত করা যায়?
মনোবিদ মরগান স্মৃতিকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ ও উন্নত করার ব্যাপারে বলেন, কোনো বিষয় সুষ্ঠভাবে শিখতে হলে তার অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, বিশ্রাম নিতে হবে, গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করার অভ্যাস করতে হবে, পুনরাবৃত্তি ও ইচ্ছাশক্তি নিয়ে শিখতে হবে। এ ছাড়াও স্মৃতিকে উন্নত করার ব্যাপারে শারীরবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানে কিছু বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। যেমন- পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা, সুস্থ দেহ ও পরিতৃপ্ত জীবন ইত্যাদি।
শিশুদের স্মৃতির উন্নতি ও প্রতিভা বিকাশের জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমেও অংশ নিতে হবে। যেমন বিতর্ক, চারুকলা, সংগীত, খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া প্রভৃতি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে হবে বলে। এগুলো তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করবে।
মনে রাখার আধুনিক পদ্ধতি
মনোবিজ্ঞানী রবিনসন অধ্যয়নের জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়মাবলি প্রণয়ন করেছেন। তার পদ্ধতিকে বলা হয় Survey Q 3R পদ্ধতি। অর্থাৎ Survey (জরিপ কর), Question (প্রশ্ন কর), Read (পড়), Recite (আবৃত্তি কর), Review (পুনরায় স্মরণ কর)।
অধ্যয়নকালে, এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মনে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হলো আগ্রহ, মনোযোগ, অভিজ্ঞতা ও অভ্যাস। পাশাপাশি প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। অবশ্য অনেকের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম হতে পারে। মনে রাখার পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমেরিকার জনপ্রিয় মনস্তত্ত্ববিদ জোসে সিলভা 'মেন্টাল এনার্জি কন্ট্রোল' নামে একটি পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন, যা মানুষের মস্তিষ্কের শক্তি এবং মনের ক্ষমতা উন্নত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। 'তিন আঙুলের কৌশল'। বা 'Three Finger Technique' তারই একটি জনপ্রিয় অংশ। এ পদ্ধতির মূলকথা হলো অখণ্ড মনোযোগের মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে সহজেই মনে রাখা যায়।
এই পদ্ধতি চর্চার শুরুতেই শরীর-মনের রিল্যাক্স করতে হবে। প্রথমে একটি শান্ত পরিবেশে বসে শরীর ও মন শান্ত করতে হবে। এরপর এক হাতের তর্জনী, মধ্যম আঙুল এবং বুড়ো আঙুল একসাথে চেপে ধরতে হবে। কয়েক সেকেন্ড ধরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনোযোগ দিতে হবে, এবং এটি যতবার প্রয়োজন ততবার এই কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ক্রমাগত অভ্যাসের মাধ্যমে যখনই এই তিনটি আঙুল একসাথে করা হবে, তখনই মস্তিষ্কক স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় অবস্থায় আনতে সাহায্য করবে।
এই কৌশলটি প্রতিদিন ব্যবহার করলে, মস্তিষ্ক এটিকে ট্রিগার হিসেবে গ্রহণ করবে এবং যখনই এই আঙুলগুলো একত্র করা হবে, মস্তিষ্ক মনকে আরও শান্ত, ফোকাসড এবং উৎপাদনশীল অবস্থায় নিয়ে যাবে। এই পদ্ধতিটি মানসিক অবস্থাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের প্রতিটি কথা ও চিন্তা ব্যক্তির মেমোরিতে রেকর্ড হয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে রেকর্ডকৃত কথাগুলো ব্যক্তির কাজের উপর প্রভাব ফেলে। আবার ফিরে যাই তিন আঙুলের কৌশলের কথায়। এ পদ্ধতি চর্চার আগে অটো-সাজেশন সম্পর্কে জানতে হবে। অটো-সাজেশন হলো মনে মনে কথা বলা। এই কথা বা চিন্তা যা-ই হোক না কেন, তা মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে থাকে। মস্তিষ্কে কথা বা চিন্তা প্রভাব ফেলে বিধায় আমাদের দেহ-মনেও এর প্রতিক্রিয়া হয়।