Image description

ফেসবুকে সরব ছিলেন, এফডিসিকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও পাওয়া যেত; তবে পর্দায় দীর্ঘদিন ধরেই অনুপস্থিত। এবার সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেলেন অঞ্জনা রহমান। ৪ জানুয়ারি মধ্যরাতে মারা গেছেন সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় এই নায়িকা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
তিন সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছিলেন অঞ্জনা রহমান। পরে রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে শারীরিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় গত বুধবার অঞ্জনাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই রাতেই তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। ভেন্টিলেশনে থাকা অবস্থায় তাঁর অবস্থার কখনো উন্নতি আবার কখনো অবনতি হচ্ছিল।

নৃত্যশিল্পী থেকে নায়িকা
মাত্র চার বছর বয়সে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পী হিসেবে অঞ্জনার আত্মপ্রকাশ। এরপর আর থেমে থাকেননি। নৃত্যশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেছেন। বাবুল চৌধুরী পরিচালিত সেতু চলচ্চিত্র দিয়ে ঢাকাই সিনেমায় কাজ শুরু করলেও তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ছিল দস্যু বনহুর (১৯৭৬)। তবে আজিজুর রহমানের অশিক্ষিত সিনেমায় রাজ্জাকের বিপরীতে প্রথম একক নায়িকা হিসেবে তাঁর অভিনয়।

২০২২ সালের মার্চে নির্মাতা আজিজুর রহমানের মৃত্যুর পর ছবিটি নিয়ে প্রথম আলোকে অভিনেত্রী বলেছিলেন, ‘পারভেজ ভাই (সোহেল রানা) হাত ধরে আমাকে সিনেমায় এনেছিলেন; কিন্তু আজিজ ভাই যদি অশিক্ষিত ছবিতে না নিতেন, আজ আমি অঞ্জনা হতে পারতাম না। আমার জীবনের মাইলফলক অশিক্ষিত। সেই গল্প, সেই সুমধুর গান আর আসবে না। আজিজ ভাইয়ের অবদান কোনো দিন ভুলব না।’ এই সিনেমার ‘আমি এক পাহারাদার’, ‘আমি যেমন আছি তেমন রবো, বউ হবো না রে’, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার’ ইত্যাদি গান একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত। মুক্তির আগে হলমালিকদের জন্য এফডিসিতে ছবির একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। গানগুলো ছাড়া পুরো ছবিটি দেখানো হলো। ছবি শেষে মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে হলের মালিকেরা পরিচালক আজিজুর রহমানকে জানান, ছবি তাঁদের পছন্দ হয়নি। নায়িকা নতুন, ছবি চলবে না। প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন অঞ্জনা। হলমালিকদের কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়লেন তিনি। তবে হলমালিকদের আশঙ্কা সত্যি হয়নি। অশিক্ষিত ছবিটি দিয়ে নতুন নায়িকা থেকে রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠেন অঞ্জনা।

পর্দায় বর্ণিল জীবন
চার দশকের ক্যারিয়ারে শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন অঞ্জনা। ঢাকাই সিনেমার তাঁর সময়ের আলোচিত প্রায় সব নায়ক ও পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন অঞ্জনা। দেশে রাজ্জাকের সঙ্গেই প্রায় ৩০টি সিনেমা করেছেন।

দেশের বাইরে ভারতের মিঠুন চক্রবর্তী, পাকিস্তানের নাদিম, ফয়সাল, জাভেদ শেখ, ইসমাইল শাহ, নেপালের শিবশ্রেষ্ঠ ও ভুবন কেসির সঙ্গেও অভিনয় করেছেন এই নায়িকা। গাঙচিল ও পরিণীতা সিনেমার জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর অভিনীত অন্য উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে আছে মাটির মায়া, চোখের মণি, সুখের সংসার, জিঞ্জির, অংশীদার, আনারকলি, বিচারপতি, আলাদিন আলীবাবা সিন্দাবাদ, অভিযান, মহান, রাজার রাজা, বিস্ফোরণ, ফুলেশ্বরী, রাম রহিম জন, নাগিনা। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে অভিনয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়েন অঞ্জনা, ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর সর্বশেষ সিনেমা ‘ভুল’। নির্মাতা আজিজুর রহমান বুলিকে বিয়ে করেছিলেন অঞ্জনা।

‘সবাই ভাবত আমরা আপন দুই বোন’
শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গতকাল বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে এফডিসিতে আনা হয় অঞ্জনার মরদেহ। শেষবারের মতো এই চিত্রনায়িকাকে দেখতে আসেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী, ভক্ত থেকে সংবাদকর্মীরা। জোহরের নামাজের পর প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বিকেলে বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

এফডিসিতে কথা বলেন শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, ‘আমাদের এখানে চলচ্চিত্রশিল্পীরা একটু সিনিয়র হয়ে গেলে আর চরিত্র থাকে না, অভিনয় থাকে না। ফলে অভিনয়শিল্পীরা একাকিত্বে থাকেন। তাঁদের অর্জনগুলো নিয়ে আমাদের আরও ভাবা উচিত। সিনিয়র শিল্পীদের এই একাকিত্ব থেকে বের করে আনার চেষ্টা করতে হবে।’
অঞ্জনার স্মৃতিচারণা করে চিত্রনায়িকা নূতন বলেন, ‘একই সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পথচলা। আমরা দুজন বোনের মতো ছিলাম। যেখানেই যেতাম, আমরা এত হাসিঠাট্টা করতাম যে সবাই ভাবত আমরা আপন দুই বোন।’
চিত্রনায়ক উজ্জল বলেন, ‘চলচ্চিত্রে নায়িকা হওয়ার আগে তিনি এ দেশের একজন খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী ছিলেন। আমি দেখেছি, সে সময় বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথি থেকে সরকারি বড় বড় অনুষ্ঠানে তাঁর নাচের ডাক পড়ত। সবাই তাঁর নাচের প্রশংসা করত। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রে এসেও অনেক কালজয়ী সিনেমায় তাঁর মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।’