Image description
 

ভিউয়ের দৌরাত্বে বাংলা নাটক কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। একসময় বাংলা নাটকের মান ও গৌরবোজ্জ্বল দিনের কথা অতীত স্মৃতির পাতায় জমা হয়েছে অনেক আগেই। যা ও কিছুটা অস্তিত্ব ছিল, তাও ভিউ বাণিজ্যের কবলে পড়ে বিলীন হতে চলেছে। 

ভিউয়ের নেশায় বুদ হয়ে থাকা প্রযোজক-পরিচালকরা বিষয়টিকে টার্গেট করে নাটকে এমন সব মানুষদের অভিনয়ের জন্য নিচ্ছেন, যারা সামাজিকমাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকান্ড করে ভাইরাল ও বিতর্কিত। উদ্ভট কান্ড করে ভাইরাল মানুষদের ভিউ বেশি, তাই অভিনয়ে কোনো জ্ঞান না থাকা স্বত্বেও তাদের যুক্ত করা হচ্ছে নাটকে। যা বিতর্কের সৃষ্টি করছে। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পেশাদার অভিনয়শিল্পীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। তবুও কোনো যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সংগঠনগুলোও রয়েছে নিরব ভূমিকায়। যেন এ নিয়ে কারও কোনো দায় নেই! পরিচালকরাও নিরুপায় বলে বারংবার দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ দায় তাহলে কার? 

অসুস্থ এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বাংলা নাটক নিয়ে। এরকম চলতে থাকলে, সবাই ভাইরাল হবার চেষ্টায় লিপ্ত থাকবে। আর তাতে সহজেই নিজের নামের সঙ্গে অভিনয়শিল্পী উপাধি যোগ করতে পারবেন বলেই ধারণা তৈরি হবে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সহজেই শিল্পী হওয়ার একটি প্রবণতা তৈরি হবে। তখন কেউ আর অভিনয় শিখতে চাইবেন না। তাতে করে নাট্যাঙ্গনে অস্থির পরিবেশ তৈরি হবে। 

সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি নাটকের ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অভিনয়শিল্পীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই নাটকের ছবিতে যে মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, সে অসামাজিক কর্মকান্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল ও বিতর্কিত। আর ভাইরাল মানেই ভিউ! তাই ভিউয়ের আশায় তাকেই নেয়া হয়েছে নাটকে। তাতেই ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন পেশাদার শিল্পীরা। 

 

ভাইরাল সেই ছবিটি পোস্ট করে ফরহাদ লিমন নামে এক অভিনেতা লিখেন, ‘অসুস্থতার শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে না তো আমাদের মানসিকতা? আজ আমরা দুটো ভিউ পাওয়ার আশায় যাকে তাকে ধরে এনে নাটকে যুক্ত করছি।’ বিষয়টি নিয়ে কথা বরেছেন জনপ্রিয় সব শিল্পীরাও। অভিনেত্রী মনিরা মিঠুও সেই পোস্ট শেয়ার করে আক্ষেপ করেছেন নাটকের এমন বেহাল দশা দেখে। এমন কান্ডে নিন্দাও জানিয়েছেন তিনি। 

এ ঘটনা প্রসঙ্গে অভিনেত্রী নাবিলা ইসলাম বলেন, ‘এটা রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে হচ্ছে। যে কেউ এভাবে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। তারা যেভাবে ভাইরাল হচ্ছেন, সেভাবেই তাদের অভিনয়ে দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অন্যরাও প্রতিনিয়ত সুযোগ পাচ্ছেন। এভাবে একটা সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এটা দিন দিন সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধৈর্য্যরে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্য কিছু ভিউয়ের জন্য শিল্পকে ছোট করা হচ্ছে। এটা যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা উচিত।’

বর্তমান সময়ে নাটকের মান যেখানে ভিউয়ের উপর নির্ণয় হয়, সেখানে এ ধরনের ভাইরাল ও বিতর্কিতদের নাটকে সুযোগ দেয়া হবে এটাও স্বাভাবিক, এমনটাই মনে করছেন নাট্যবোদ্ধারা। তাদের মতে, মানের দিক বিবেচনা না করে, ভিউয়ের ওপর এখন নাটকের দর্শকপ্রিয়তা বিচার করা হচ্ছে। ফলে নির্মাতা-শিল্পীরাও ভিউয়ের পেছনে ছুটছেন। সেই আশায় ভাইরাল মানুষদের নাটকে যুক্ত করছেন। তাতে করে নাটকের মান যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি করে তৈরি হচ্ছে কান্ডজ্ঞ্যানহীন অদক্ষ কিছু শিল্পী। 

এ বিষয়ে নাট্যজন মামুনুর রশীদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভিউয়ের জন্য যা করা হচ্ছে এগুলো অসভ্য, বর্বর লোকের কাজ। কোনো সৃষ্টিশীল মানুষদের এগুলো করতে রুচিতে বাঁধবে। টিভি নাটক তো অনেক আগেই গেছে, কিন্তু এখন ইউটিউব এতটাই জঘন্য পর্যায়ে গিয়েছে, যা নাটককে তলানিতে নিয়ে ঠেকাচ্ছে। ভিউ বাড়াতে গিয়ে সবাই যেন নাটক নিয়ে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। আসলে এগুলোকে নাটক বললেও ভুল হবে। আমি মনে করি এগুলো নেহাতই কনটেন্ট।’

নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘নাটকের ব্যবসায় এখন আর শিল্পচর্চা নেই। ভিউয়ের দৌড়ে কে কত এগিয়ে থাকবে এ চর্চা চলছে। এমন একটা সময়ে এখন আমরা রয়েছি, এখানে আসলে পরিচালকদের কিছু করার থাকছে না। প্রযোজক যাকে দিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন বলে মনে করবেন, তাকেই তো কাস্ট করবেন। পরিচালকদের সে ক্ষেত্রে চুপ থাকতে হচ্ছে। এখানে যদি রুচির দূর্ভিক্ষ নিয়েও কথা বলি, সেটি নিয়েও তর্ক-বিতর্ক হবে। কারণ, অভিনয় করার অধিকার সবার আছে। কাউকেই আসলে না করা যাবে না। নাট্যাঙ্গন কিভাবে এটা থেকে পরিত্রাণ পাবে সেটা আমি নিজেও জানি না। আমিও খুব বিস্মিত হই বা হচ্ছি।’