
ইউটিউবার, টিকটক কিংবা ফেসবুকে প্রতিনিয়তই ভাইরাল হচ্ছেন অনেকে। তাঁরা ভাইরাল হলেই পরবর্তী সময় সহজেই নাম লেখাচ্ছেন অভিনয়শিল্পী হিসেবে। ভিউকে টার্গেট করে এসব ভাইরাল ব্যক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন প্রযোজক ও পরিচালকেরা। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা অভিনয়শিল্পীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই চর্চায় সহজে শিল্পী হওয়ার প্রবণতা তৈরি হলে, যে কেউ যেকোনো উপায়ে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করবেন, যা নাট্য অঙ্গনের শিল্পচর্চাকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যাবে। কেউ অভিনয় শিখতে চাইবেন না।
সম্প্রতি তরুণ অভিনেতা ফরহাদ লিমন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘অসুস্থতার শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে না তো আমাদের মানসিকতা? আজ আমরা দুটো ভিউ পাওয়ার আশায় যাকে–তাকে ধরে এনে নাটকে যুক্ত করছি।’

সম্প্রতি শুটিং হওয়া একটি নাটকের এক অভিনয়শিল্পী প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আজ যাঁকে দিয়ে অভিনয় করানো হচ্ছে, তিনি বিভিন্ন সময়ে তাঁর বান্ধবীদের স্বামীর সঙ্গে কক্সবাজারে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছেন। তাঁর বান্ধবীরা তাঁকে বকাবকি করছে, মারতেও গিয়েছে, তাঁর এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিও নিয়ে মেয়েটির ভ্রুক্ষেপ নাই। তিনি লাইভে এসে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এগুলো উপভোগ করেন। অথচ নাটক ভাইরাল করার জন্য তাঁকেই অভিনয়ে যুক্ত করা হয়েছে।’
অভিনেতা ফরহাদের ফেসবুকের কথাগুলোর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন অভিনয়শিল্পী মনিরা মিঠু, নাবিলা ইসলাম, আবদুল্লাহ আল সেন্টু, হিমে হাজিফ, স্নিগ্ধা হোসাইনসহ অনেকে।
নাবিলা ইসলাম বলেন, ‘এটা রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে হচ্ছে। যে কেউ এভাবে অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরা যেভাবে ভাইরাল হচ্ছেন, সেভাবেই তাঁদের অভিনয়ে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অন্যরাও প্রতিনিয়ত সুযোগ পাচ্ছেন। এভাবে একটা সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এটা দিন দিন সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্য কিছু ভিউয়ের জন্য শিল্পকে ছোট করা হচ্ছে। এটা যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করা উচিত।’
তরুণ অভিনেতা আবদুল্লাহ আল সেন্টু আক্ষেপ নিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা শিল্প দিয়ে টাকা উপার্জন করতে শিখি নাই, আমরা শিখেছি কীভাবে সহজ লাইনে টাকা উপার্জন তৈরি করা যায়। এই সবের জন্য আমি–আপনি–আমরা সবাই দায়ী। এভাবে চলতে থাকলে শিল্পী তৈরি হবে না। কেউ আর অভিনয় শিখে আসবেন না।’
খবর নিয়ে জানা যায়, এর আগে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করে আলোচিত একজন অভিনয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া অসুস্থ অঙ্গভঙ্গি করে, অসংলগ্ন কথা বলে একাধিক ব্যক্তি অভিনয়ে এসেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন হিরো আলম, ইয়াসিন অপু, মিরাজ খান, সাবরিনাসহ অনেকে।
অভিনেতা লিমন মনে করেন, ‘এভাবে যদি কেউ অভিনয়ে সুযোগ পায়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম কেন সুস্থ ধারায় অভিনয়ে আসার চিন্তা করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের নৈতিক অবক্ষয় বন্ধ হয়, সামনে কেউ আর আর্ট কালচার শিখতে চাইবে না। যেকোনো পদ্ধতিতে ভাইরাল হবে।’

এ আগে দুজন টিকটকারকে দিয়ে নাটক নির্মাণ করেছিলেন এই নির্মাতা। তিনি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘আমি ভাই বাধ্য হয়ে নিয়েছিলাম। নাটকের ভিউ লাগবে, প্রযোজকের ডিমান্ড। আমাকে তো কাজ করে খেতে হয়, কিছু বললে এই কাজ অন্যজনকে দিয়ে করাবে। এই জন্য একবারই করেছিলাম। পরে বুঝতে পারলাম, তাঁরা আসলে শিল্পী হওয়ার জন্য নয়, নিজেকে চেনানোর জন্যই মিডিয়ায় এসেছেন। তাঁদের বেশির ভাগের মধ্যেই শৈল্পিক চিন্তা নেই, ভাইরাল চিন্তাই মাথায় কাজ করে।’
পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিন দিন ভিউ–দৌড়ে নাটক ব্যবসা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই বিজনেসে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পচর্চা। এখানে ডিরেক্টরদের কিছুই করার থাকছে না। কারণ, প্রযোজক যাকে দিয়ে ব্যবসা হবে, তাকে কাজে নেবেন। ডিরেক্টরদের চুপ থাকতে হচ্ছে। আবার রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা তুললেও তর্ক–বিতর্ক হচ্ছে। এখন অভিনয় করার অধিকারও সবার আছে। কাউকে না করা যাবে না। এটা থেকে নাট্য অঙ্গনের পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব, সেটা আমি নিজেও জানি না।’