Image description

শিল্পকলার কাজে সংস্কৃতি উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের "অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের (ডিজি) পদ থেকে নাটকীয়ভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগের আয়োজনে 'মুনীর চৌধুরী প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসব'–এর সমাপনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার এক পর্যায়ে একাডেমির সচিব মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনের কাছে পদত্যাগপত্র তুলে দেন তিনি।

ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। জনসম্মুখে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আগে ও পরে দেওয়া বক্তব্যে তিনি জানান, 'স্বাধীনভাবে কাজ না করতে পারায়' এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে এ নিয়ে তিনি একটি লিখিত বক্তব্যও দেন।

কিন্তু মি. আহমেদের জনসম্মুখে পদত্যাগ করার এই ঘটনা নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা চলছে। বিশেষ করে, আজ শনিবার দুপুরে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এ নিয়ে একটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর থেকে আলোচনা আরও ডানপালা মেলেছে।

ঠিক কী কী কারণে মি. আহমেদ পদত্যাগ করলেন এবং তিনি কোন ধরনের হস্তক্ষেপের কথা বারবার বলছেন, এ বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা'র বক্তব্য কী, অনেকেই এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা প্রশ্ন তুলেছেন।

সৈয়দ জামিল আহমেদের হাতে পদত্যাগপত্র
ছবির ক্যাপশান,সৈয়দ জামিল আহমেদের হাতে পদত্যাগপত্র

শুক্রবার যা হয়েছিলো

সৈয়দ জামিল আহমেদ গতকাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "আমার বয়স হয়েছে এখন ৭০ বছর। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জন্য আমি যে কাজ করেছি, এখন আর মন্ত্রণালয়ে দশবার করে লড়াই করে তাদের হাত পা ধরার আমার কোনও জায়গা নাই, দরকারও নাই।"

শিল্পকলা একাডেমি ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ যেমন চেয়েছিলেন '১৬৫ কোটি টাকা', সেটা দেয়া হয়নি। বরং, যারা বরাদ্দের সাথে থাকেন তারা "মনে করে এটা তাদের নিজের টাকা, এভাবে টাকাটা বণ্টন করা শুরু করেছে তারা," বলেন মি. আহমেদ।

তিনি তখন আরও বলেন, "আমাদের যেন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ হয়, তার জন্য সবার আগে দরকার এই মন্ত্রণালয়ে আমাদের যত রকম কর্মচারীরা আছেন, তারা একটু বুঝুক যে এখানে একটা গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী জায়গায় আমরা কাজ করছি।"

"এখানে কাজ করা সম্ভব হবে না" উল্লেখ করে এরপর মঞ্চে থাকা শিল্পকলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনের হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।

পদত্যাগপত্র দেওয়ার পর তিনি বলেন "যেহেতু পদত্যাগপত্র আমি দিয়ে দিয়েছি, আমাকে যে বলতে বাধা দিয়েছিলো যে– আমরা আদিবাসী কথাটা বলতে পারবো না। আমি আজকে বলছি, আদিবাসীদের বিরুদ্ধে... আদিবাসীদের দাবি পূর্ণ হোক, তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধ হোক, তাদের অধিকার অর্জিত হোক। আমি একইসাথে চাই বৈষম্যহীন বাংলাদেশ কায়েম হোক।"

এরপর ওই ঘটনা নিয়ে মি. আহমেদ গণমাধ্যমে যে লিখিত বক্তব্য দেন, সেখানে তিনি বলেন– "উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার জটিলতা, একাডেমির সচিবকে 'ফোকাল পারসন' হিসেবে মনোনীত করে মহাপরিচালকের বিধিসম্মত দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান, বাজেট কর্তন, শিল্পকলার ভেতর থেকে ফাইল গায়েব করে দেওয়া, একাডেমির অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে প্ররোচিত করে কাজের পরিবেশ ব্যাহত করা এবং দুর্নীতিবাজ চক্রের নানা অপতৎপরতার কারণে" তিনি মহাপরিচালক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।

এদিকে, শিল্পকলার সচিব মি. হোসেন পরে বলেন, "আমি শিল্পকলার সচিব হিসাবে এটা শুধু হাতে নিয়েছি। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির কোনও কর্মকর্তা কর্মচারী এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা গতকাল শিল্পকলা একাডেমিতে উপস্থিত ছিলেন। তার সাথে শনিবার বিবিসি বাংলা'র কথা হয়।

মিজ লুৎফা বলেন, "আমরা থিয়েটার কর্মীরা চেষ্টা করেছি, উনি এখানে থাকুক। আমরা ওনাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি...যখন শুনেছি যে উনি পদত্যাগ করেছেন... আমার দলের কয়েকজন ওই অনুষ্ঠানে ছিল, আমি রিহার্সালে ছিলাম... এটা শুনে গিয়েছি।"

তিনি জানান, তিন মাস আগে মিটিং হয়েছিলো। সেই মিটিং-এর ফলাফল ইতিবাচক ছিল। সেখানে শিল্পকলা আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।

"সেই মিটিং খুবই ইতিবাচকভাবে শেষ হয়েছিলো। ওখানে বর্তমান উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিল। সেখানে আমি ওরকম কিছু সেন্স করি নাই। আর ভেতরের খবর আমি জানি না।"

সৈয়দ জামিল আহমেদের লিখিত ব্যাখ্যা
ছবির ক্যাপশান,সৈয়দ জামিল আহমেদের লিখিত ব্যাখ্যা

মহাপরিচালক পদ থেকে ইস্তফা দেবার কারণ

লিখিত বক্তব্যে মি. আহমেদ তার পদত্যাগের কারণগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন যে বহুজনের অনুরোধে তিনি গত নয়ই সেপ্টেম্বর সচিব পদমর্যাদায় মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তা এই শর্তে যে শিল্পকলা একাডেমি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করবে এবং সেখানে মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ থাকা যাবে না।

তার দাবী, তৎকালীন উপদেষ্টা ও সচিবালয়ের সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার প্রস্তাব ও কর্মপরিকল্পনায় সম্মত হলে সকলের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

কিন্তু, "উপদেষ্টা পরিবর্তনের পর থেকে আমার সকল বিধিসম্মত কাজে নীতি-বহির্ভূত পদ্ধতিতে বারংবার হস্তক্ষেপ শুরু হয়। একাডেমির সকল কর্মকাণ্ডকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শ্লথ করে দেবার প্রচেষ্টা চালানো হয়" বলে তিনি সেখানে উল্লেখ করেন।

উদাহরণ হিসাবে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আইন অনুযায়ী প্রতি তিন মাস পর পর একাডেমির সভা করার বিধান থাকা সত্ত্বেও পরিষদ সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন করতে উপদেষ্টা পাঁচ সপ্তাহ অহেতুক সময় নেন।

একটি ভিডিও নির্মাণের জন্য তাকে কোনও লিখিত চিঠিপত্র ব্যতিত উপদেষ্টার পক্ষ থেকে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হলে তিনি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন বলেও জানান।

তিনি বলেন যে মহাপরিচালক পদে যোগদানের সময় তিনি যে ভিশন ও মিশন উপস্থাপন করেছিলেন, সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তৃণমূল হতে কেন্দ্র পর্যন্ত সংস্কার, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রায়নের জন্য বরাদ্দ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভায় উত্থাপন করলে তা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে বরাদ্দ করা হয়।

"এমতাবস্থায়, চতুর্দিকে ঘিরে থাকা চক্রের সঙ্গে আপোস করে আমার পক্ষে যে উদ্দেশ্য নিয়ে দায়িত্ব নিয়েছিলাম, সেই লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় বিধায় আমি পদত্যাগ করেছি" বলে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ফেসবুক পোস্ট

উপদেষ্টার পাল্টা অভিযোগ

এদিকে, সৈয়দ জামিল আহমেদের পদত্যাগ ও অভিযোগের বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, "ভালো শিল্পী হওয়া আর আমলাতন্ত্রকে কনফিডেন্সে নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো দুইটা দুইরকম আর্ট।"

"দ্বিতীয় কাজটা করবার জন্য লাগে ধৈর্য এবং ম্যানেজারিয়াল ক্যাপাসিটি," তিনি যোগ করেন।

মি. ফারুকী আরও বলেন, "কলিগদের বুলিং না করে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দিয়ে অনেক কাজ আদায় করে নেয়া যায়। পাশাপাশি, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গেলে যে কম্পোজার লাগে, সেটার সাথে কোনও একটা থিয়েটার দলে নির্দেশনা দেয়ার টেম্পারামেন্ট এক না। আমার ফিল্ম ইউনিটে আমি যা করতে পারি, একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে আমি তা করতে পারি না।"

'শুধু এইটুকু আপাতত বলে রাখি, উনার বলা অনেকগুলা কথা পুরো সত্য নয়, অনেকগুলা কথা ডাহা মিথ্যা এবং কিছু কথা পরিস্থিতি ডিল না করতে পারাজনিত হতাশা থেকে বের হয়ে আসা বলে মনে হচ্ছে। আমার বিস্তারিত লেখা হয়তো উনাকে বিব্রত করতে পারে। কিন্তু আমাকে আপনি এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন, যেখানে আমাকে বিব্রতকর হলেও সত্য বলতে হবে, জামিল ভাই।'

ফারুকী লিখেছেন, 'আমি জামিল ভাইয়ের নাটকীয় পদত্যাগ নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম না। কারণ, তাতে আমাকে এমন কিছু উদাহরণ টানতে হবে, যেটা তাঁর জন্য অস্বস্তিকর হবে। আমি চাচ্ছিলাম না, কারণ আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ফর রেকর্ডস আমাকে আসলে এগুলো বলতেই হবে। আজকে আমাদের অনেকগুলা কাজ আছে। এটা শেষ করে সময় পেলে লিখব।'

সেই সাথে সংস্কৃতি উপদেষ্টা আরো লিখেছেন, 'আমি উনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি। উনার সৃজনশীল কাজে যেকোনোভাবে সহযোগিতা করতে পারলে মন্ত্রণালয় ধন্য হবে। আর আমি আমার দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার পরও তাঁর কোনো সাহায্যে আসলে আনন্দিত হব; যদিও আমাদের দুইজনের কাজের ক্ষেত্র আলাদা।'

এই ঘটনার বিষয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টার সাথে কথা বলার জন্য বিবিসি'র তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মহাপরিচালক পদে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় নাট্যনির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদকে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।